Old Documents

বাংলাদেশে মাওবাদ অনুশীলনের অভিজ্ঞতা এবং  মাওবাদ রক্ষা ও বিকাশের সমস্যা


বাংলাদেশেমাওবাদী আন্দোলনের সূুচনা হয় ষাটের দশকের শেষার্ধে - যা কিনা বিশ্বের আরোবহু দেশের জন্যও প্রযোজ্য। মাওসেতুঙের নেতৃত্বে চীনের মহান সর্বহারাসাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাবে ক্রশ্চভীয় সংশোধনবাদের এদেশীয় দোসরদেরবিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তবে শুরু থেকেইএদেশের মাওবাদী আন্দোলন বহুধা বিভক্ত ছিল। আমাদের পার্টি ছিল এ আন্দোলনেরএকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা - যার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শহীদ কমরেড সিরাজ সিকদার।আমাদের পার্টির বাইরে আরো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারা শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল- যে ধারাগুলো নিজ নিজ পথেই বিকশিত হয়েছে - যেমনি আমাদের পার্টিও হয়েছে।এখনো আমাদের দেশের মাওবাদী আন্দোলন সেই বিভক্তির ধারাকে অতিক্রম করতেপারেনি। তাই, বাংলাদেশে মাওবাদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের পার্টির অভিজ্ঞতাহলো এদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষিতে আংশিক। এদেশের মাওবাদী আন্দোলনকে সমগ্রভাবেবিবেচনা করার কাজ অল্প কিছু সময় ধরে শুরু হয়েছে - যাতে আমাদের পার্টিসক্রিয় অংশ গ্রহণ করছে। তবে এখনো তার সংশেষণ সম্পূর্ণতা পায়নি। তাই, আমাদেরপক্ষে প্রধানতঃ আমাদের পার্টির নিজস্ব অভিজ্ঞতাকেই ভালভাবে যাচাই করাসম্ভব - যদিও সমগ্র অন্দোলনের অন্যান্য শিক্ষাকেও আমরা এ নিবন্ধে যতটাসম্ভব যুক্ত করার চেষ্টা করবো।
* বাংলাদেশে মাওবাদী আন্দোলনের ইতিহাসকেতিনটি প্রধান পর্বে ভাগ করা যায়। এর প্রথম পর্বটি হলো ষাট/সত্তর দশকেরবিশ্ব বিপ্লবের উত্তাল সময়কালের পর্ব। এ সময়েই মাওবাদী আন্দোলন এদেশে শিকড়গাড়ে, এবং বলা যায় কমিউনিষ্ট নেতৃত্বাধীন প্রথম স্বতন্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনএদেশে গড়ে ওঠে। এর দ্বিতীয় পর্বটি শুরু হয় এই বিপ্লবী উত্থানের বিপর্যয়েরপর, বিশেষতঃ ৭৬-সালে মাও-মৃত্যুর পর বিশ্বব্যাপী কমিউনিষ্ট আন্দোলনেরসামগ্রিক বিপর্যয়কালে। যে পর্বটি চলতে থাকে বিগত শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত।আর তৃতীয় পর্বটি গত শতাব্দীর শেষে বা এ শতাব্দীর শুরু থেকে আরম্ভ হয়েছে।যদিও এই প্রতিটি পর্বকে বেশ কিছু উপ-পর্বে (পর্যায়ে) ভাগ করা যায়, তবুওমাওবাদের রক্ষা এবং তার উপলব্ধির ও বিকাশের ক্ষেত্রে মাওবাদী আন্দোলনেরসমগ্র ইতিহাসকে উপরোক্ত তিনটি প্রধান পর্বে বিভক্ত করাটাই ভাল হবে।
 মাওবাদপ্রয়োগের ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত প্রথম পর্বটি হলো মাওবাদকে (তৎকালে মাওচিন্তাধারাকে) মতাদর্শগত ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ, এবং মাওবাদের ভিত্তিতেকমিউনিষ্ট আন্দোলন ও প্রকৃত বিপ্লবী সংগ্রামের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করারসময়কাল। এ পর্বে প্রধান সমস্যা ছিল মাওচিন্তাধারাকে গ্রহণ, তথা তাকেআমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদী সর্বহারা মতাদর্শের তৃতীয় স্তর হিসেবে গ্রহণেরসমস্যা। প্রকৃত মাওবাদীরা বাদেও সেই উত্তাল সময়ে প্রগতিশীল অনেক বামপন্থীমাওকে তুলে ধরেছিল বটে, মাওচিন্তাধারার কথাও অনেকে বলেছিল, কিন্তুমাওচিন্তাধারাকে মতাদর্শের তৃতীয় স্তর হিসেবে তারা গ্রহন করেনি। এই অংশটাঅচিরেই একে একে মাওচিন্তাধারাবিরোধী হিসেবে নিজেদেরকে প্রকাশ করা শুরু করে।এমনকি মাওচিন্তাধারাকে তৃতীয় স্তর হিসেবে গ্রহণকারীদের মাঝেও ছিল উপলব্ধিরব্যাপক অসমতা ও দুর্বলতা। সুতরাং মৌলিক সমস্যা ছিল মতাদর্শের তৃতীয় স্তরহিসেবে মাওবাদকে গ্রহণ করার সমস্যা। এটাই ছিল গখগ-রক্ষা ও প্রয়োগেরক্ষেত্রে এই প্রথম পর্বের প্রধানতম সমস্যা।
এর সাথেই যুক্ত বিষয় ছিলগখগ-এর সৃজনশীল প্রয়োগের সমস্যাটি। যে বিষয়ে মহামতি লেনিন বহু আগেই উল্লেখকরেছিলেন, মার্কসবাদ বেদবাক্য নয়, কর্মপরিচালনার গাইড। মাও এ তত্ত্বকে আরোগভীরতা দান করেন দর্শনের ক্ষেত্রে তার অবদানের মাধ্যমে - দ্বন্দ্বেরবিশিষ্টতা ও জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায়। সমাজ-বিপ্লবের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বেরবিশিষ্টতা প্রয়োগ করলে আমরা দেখি যে, প্রতিটি দেশের সমাজ অন্য দেশের সমাজথেকে পৃথক; আর সময়ের অগ্রগতির সাথে প্রতিটি সমাজই বদলে যায় - যদিও একটিনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগে সমাজগুলোর মাঝে মৌলিক অভিন্নতাও রয়েছে। সুতরাংবাংলাদেশের সমাজে গখগ-কে সৃজনশীল প্রয়োগের প্রশ্নে এদেশের মাওবাদী আন্দোলনেশুরু থেকেই বিতর্কের উদ্ভব ঘটে। চীন বা ভারতের মত একই ধরনের সমাজ বলেহুবহু একই লাইন নিয়ে আসার একটা গোড়ামীবাদী প্রবণতা ও বিচ্যুতি সূচনা থেকেইএদেশের মাওবাদী আন্দোলনে বিরাজমান ছিল - যা প্রকাশ পাচ্ছিল রাজনৈতিক ওসামরিক লাইনের ক্ষেত্রে। কমরেড সিরাজ সিকদার এই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকরেন।
কিন্তু উপরোক্ত গোড়ামীবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে ওসৃজনশীলভাবে গখগ প্রয়োগ করতে গিয়ে ক. সিরাজ সিকদারের মাঝে বিপরীত ধরনেরবিচ্যুতি আমরা লক্ষ্য করি। এটা রাজনৈতিক লাইনে জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি আনে - যা কিনা গখগ-এর মূূলনীতির গভীর উপলব্ধি ও তার প্রতি দৃঢ় থাকার ক্ষেত্রেদুর্বলতার সাথে যুক্ত ছিল।
সুতরাং এ প্রথম পর্বে  একদিকে গোড়ামীবাদ, অন্যদিকে অভিজ্ঞতাবাদ বা প্রয়োগবাদ - এই উভয় ধরনের সমস্যা থেকে আমাদেরমাওবাদী আন্দোলন মুক্ত হতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ, এ পর্বে গৌরবময় সংগ্রামসত্ত্বেও বিপ্লব সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। এ সময়ে মাওবাদকেভালভাবে উপলব্ধি ও আয়ত্ত্ব করায় দুর্বলতা থেকে যায়। মাও-এর নয়াগণতন্ত্র ওগণযুদ্ধের তত্ত্বকে, এবং চীন-বিপ্লবপূর্ব মাও-এর দার্শনিক অবদানগুলোকেগ্রহণ ও প্রয়োগের চেষ্টা হলেও প্রকৃতপক্ষে এচঈজ-কালে মাও কর্তৃক মতাদর্শেরসর্বাঙ্গীণ গুণগত বিকাশকে ততটা গভীরভাবে আয়ত্ত্ব করা যায়নি। এমনকিনয়াগণতন্ত্রের ক্ষেত্রে কৃষি-বিপ্লবের সমস্যাকে জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরা যায়নি- একাংশের মাঝে জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতির ঝোঁকের জন্য ; আর অন্য অংশের মাঝেসনাতন অর্থনীতিবাদ ও সংস্কারবাদের থেকে জঁঢ়ঃঁৎব না হয়ে কৃষক-সমস্যাকে ধরারকারণে। তেমনি গণযুদ্ধের প্রশ্নেও উপলব্ধির ব্যাপক দুর্বলতা ছিল। গণযুদ্ধেরমতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রকৃতি ও তাৎপর্যে যতনা গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, তার চেয়েবেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল সংগ্রামের সশস্ত্র রূপের উপর। এলাকা-ভিত্তিকক্ষমতাদখল তথা ঘাটি-প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্রে রেখে সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রধানকরে গনলাইন, গনভিত্তি, গনসংগ্রাম, গনসংগঠনসহ গনযুদ্ধকে এক ব্যাপকগন-রাজনৈতিক তৎপরতা হিসেবে পরিচালনার বদলে গেরিলা লড়াই-এর উপর একতরফা জোরপ্রদান করা হয়। অন্যদিকে স্বতঃস্ফুর্ত তৎপরতার মধ্যদিয়ে সনাতন বা নতুন রূপেসশস্ত্র অর্থনীতিবাদী বা সংস্কারবাদী বিচ্যুতি ঘটে যা বিপ্লবী রাজনীতিকেদুর্বল করে। একদিকে বিশেষ অবস্থার যুক্তিতে গণঅভ্যূত্থানের/দেশব্যাপীছড়ানোর কথা বলে গণযুদ্ধে ঘাঁটির তাৎপর্যকে সঠিকভাবে বোঝা হয়নি ও আঁকড়ে ধরাহয়নি। অন্যদিকে এলাকাভিত্তিক ক্ষমতাদখলের নামে গুরুতর এলাকাবাদী তৎপরতা গড়েতোলা হয় যা ঘাটির লক্ষ্যে রননৈতিক অঞ্চল আকড়ে ধরার কোন পরিকল্পনার বদলেস্বতঃস্ফুর্ত বিকাশের পথে কাজ করতে থাকে।
তাই, আমরা দেখতে পাচ্ছি, মাওবাদ গ্রহণের এই প্রথমাবস্থায় বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণের নামে অথবাগোড়ামীবাদী ধরনে গখগ-এর মূল নীতির কিছু মৌলিক প্রশ্নে আমাদের আন্দোলনবিচ্যুত হয়। উপরন্তু এচঈজ-এর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মাওবাদকে ভালভাবেউপলব্ধি ও আয়ত্ত্ব করতে না পারায় দর্শন-দৃষ্টিভঙ্গি, পার্টি-গঠন, শ্রেণী-লাইন, গণলাইনফ্রণ্ট ও মেথডলজীসহ মৌলিক প্রশ্নাবলীতে দুর্বলতা ওবিচ্যুতি দেখা দেয়। এবং একটি অগ্রসর মাওবাদী পার্টি-গঠন ও বিপ্লব নির্মাণেব্যর্থতা আসে।
* ৭৬-সালে মাও-মৃত্যুর পর চীনে তেং-হুয়া চক্র ক্ষমতা দখল করে মহান চীনা পার্টিকে সংশোধনবাদে অধঃপতিত করে; অন্যদিকে আলবেনিয়ার হোক্সা স্ট্যালিনের পক্ষাবলম্বনের যুক্তিতে মাওবাদের উপর এক সার্বিক আক্রমণ চালায়। ইতিমধ্যেই ষাট-সত্তর দশকের বিশ্বব্যাপী গণউত্থানে বিপর্যয় ও ভাটা নেমে এসেছিল - যা উপরোক্ত ঘটনাবলীতে পূর্ণতা পায়। মাওবাদী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী এক সার্বিক বিপর্যয়ে পতিত হয় - যা থেকে বাংলাদেশের আন্দোলনও মুক্ত ছিলনা। বাস্তবে এদেশে প্রথম পর্বের মাওবাদী বিপ্লবী উত্থান ৭৫-সালের প্রথমার্ধেই সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ৭৬ পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী নতুন মতাদর্শগত মহাবিতর্কের কালে এদেশেও ব্যাপকভাবে দলত্যাগ, অধঃপতন, বিভ্রান্তি ও হতাশা নেমে আসে। সকল ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল, সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের আক্রমণের মুখে মাওবাদকে রক্ষার প্রশ্নটি প্রধান হয়ে ওঠে। যার প্রধান রূপ তখন হয়ে দাড়ায় বিগত মাওবাদী আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগ্রামের সমর্থন, পক্ষাবলম্বন ও রক্ষা করার প্রশ্ন। পূর্বতন মাওবাদীদের একটা অংশ এচঈজ-এর বিরুদ্ধে তেং-পন্থাকে সমর্থন করে ও সংশোধনবাদী তিনবিশ্ব তত্ত্বকে মাও-এর ঘাড়ে চাপায়। অন্যদিকে তিন বিশ্ব তত্ত্ব ও তেং-পন্থাকে বিরোধিতার অজুহাতে অন্য এক বড় অংশ মাও ও এচঈজ-এর উপর আক্রমণ চালায়। এ উভয় পক্ষের সাধারণ আক্রমণস্থল ছিল দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ, এচঈজ ও মাওবাদ। এই জটিল সংকটজনক সময়ে আমাদের দেশের স্বল্পসংখ্যক মাওবাদী বিপ্লবী দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের তত্ত্ব ও বিগত সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের পক্ষে দাড়ান। আন্তর্জাতিক মতাদর্শগত মহাবিতর্কে তারা তেং-পন্থা ও হোক্সাপন্থার বিপরীতে এচঈজ ও মাওবাদকে উর্ধ্বে তুলে ধরেন। এ সময়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রকৃত মাওবাদী বিপ্লবীদের নতুন মেরুকরণের প্রক্রিয়ায় আমাদের পার্টিসহ এদেশের মাওবাদী আন্দোলনের বৃহৎ অংশ জওগ-এ ঐক্যবদ্ধ হয়, যা আবার দেশীয় ক্ষেত্রে মাওবাদ রক্ষায় বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
আমরা যখন আজ পিছন ফিরে এই দ্বিতীয় পর্বের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করতে যাই, তখন দেখা যায় যে, এচঈজ-এর শিক্ষা সম্পর্কে প্রথম পর্বের চেয়ে উচ্চতর উপলব্ধিই মাওবাদকে রক্ষার ক্ষেত্রে মাওবাদীদেরকে সক্ষম করে  তুলেছিল। বাস্তবে গখগ-কে রক্ষা করার সংগ্রাম এই উপলব্ধিকে গভীর করার প্রয়োজন সৃষ্টি করেছিল এবং এ লাইনগত সংগ্রামই তাকে এগিয়ে দেয়। এ সময়ে দর্শন (দ্বন্দ্ববাদ), সমাজতন্ত্র (সর্বহারা একনায়কত্বাধীনে অব্যাহতভাবে বিপ্লব চালিয়ে যাওয়া), পার্টি (২খঝ-এর মধ্যদিয়ে বিকাশ) প্রভৃতি সম্পর্কে মাও-এর অবদানকে মাওবাদীরা গভীরতরভাবে আয়ত্ত্ব করতে থাকেন। কিন্তু গণযুদ্ধের প্রশ্নে পূর্বতন লাইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ছাড়া উপলব্ধিতে গুণগত অগ্রগতি হয়নি। এমনকি উপরোক্ত তিনটি প্রশ্নেও মাওবাদের উপলব্ধি ও প্রয়োগে দুর্বলতা বজায় থাকে। এইসব অগ্রগতি ও দুর্বলতা উভয়েরই প্রকাশ ঘটে ৮০ ও ৯০-দশকে এদেশের মাওবাদী আন্দোলনের নতুন উত্থানে - যা মাওবাদকে রক্ষা করে, প্রথম পর্বের মাওবাদী বিপ্লবী ঐতিহ্যকে রক্ষা করে, তার লাইনগত বিকাশ ঘটায় এবং নতুন বিপ্লবী উত্থানও ঘটায় ; কিন্তু পাশাপাশি কিছুদুর এগিয়ে এ উত্থান পুনরায় বিপর্যয়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
এই পর্বে মাওবাদী আন্দোলনকে রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল একদিকে বিপ্লবী লাইনকে রক্ষা ও পাশাপাশি তার বিকাশ সাধনের বিষয়টি। প্রথম পর্বের পরাজয়ের পর যখন প্রধান কাজ ছিল মাওবাদকে বর্জন করার বিলোপবাদকে সংগ্রাম করা, তখন মাওবাদী আন্দোলনে একটা শক্তিশালী ধারা হিসেবে দেখা দেয় প্রথম পর্ব সম্পর্কে একটা বিশুদ্ধতাবাদী ধারা। এটা বলতে থাকে আমাদের লাইন ঠিক, সুতরাং সে বিষয়ে কোন প্রশ্ন নেই। শত্র“-দমনে, নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে বা বিশ্বসঘাতকতায় অথবা প্রয়োগের বিচ্যুতি/দুর্বলতায় সংগ্রাম বিপর্যস্ত হয়েছে। এই ধারাটি প্রথম পর্বের লাইনকে এমনভাবে উত্থাপন করতে থাকে যা কিনা পার্টির মতাদর্শের সমপর্যায়ে বা তার কাছাকাছি ধরণে তাকে স্থাপন করতে থাকে। ঝঝ-শিক্ষা বা ঈগ-শিক্ষার নামে এই চেতনা নিজেকে প্রকাশ করে। এ অবস্থায় বিপ্লবী মাওবাদী আন্দোলনকে একদিকে ঝঝ/ঈগ/প্রথম পর্বের বিপ্লবী অবদানকে রক্ষা করতে হয়েছে ; অন্যদিকে তাদের অসম্পূর্ণতা/দুর্বলতা/বিচ্যুতিকে অতিক্রম করার কাজকে হাতে নিতে হয়েছে। অবশ্য মাওবাদী আন্দোলনে শক্তিশালী ধারা হিসেবে উপরোক্ত বিশুদ্ধতাবাদী লাইন থেকে গিয়েছিল এবং এখনো তা রয়েছে - যা কিনা পুরনো পরাজিত বিপ্লবের পুনরাবৃত্তির এক নিস্ফল চেষ্টায় মতাদর্শগত-রাজনৈতিকভাবে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়েছে ; নতুবা গোড়ামীবাদী ধরনে বিপ্লব-বিচ্ছিন্ন কথামালার মাওবাদে পরিণত হয়েছে। যাহোক অগ্রসরমান ধারাটি প্রথম পর্বের সারসংকলনের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী লাইনকে বিকশিত করার ফলেই আন্দোলনের পুনঃগতি সঞ্চার হয়েছে, এবং লাইন নতুন উচ্চতর লেবেলে উন্নীত হয়েছে। যদিও আরো পরে, এই দ্বিতীয় পর্বেরও বিপর্যয়কর সমাপ্তির পরে আমরা আজ বলতে পারি যে, উপরোক্ত সারসংকলন অতীত লাইন থেকে জঁঢ়ঃঁৎব করতে পারেনি, এবং ফলে কিছু কিছু নতুন দুর্বলতাকেও তা সৃষ্টি করেছিল - ফলে এ দেশের বিপ্লবের জন্য উপযুক্ত সামগ্রিক একটি সঠিক লাইনের নির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকে। আর বিপ্লবের পুনঃবিপর্যয়ের ফলস্বরূপ হতাশা, বিভ্রান্তি, অধঃপতন, বিশ্বসঘাতকতা - এসব কিছুর পাশাপাশি ব্যাপক বিভক্তিও মাওবাদী আন্দোলনে গড়ে ওঠে। এদেশের মাওবাদী আন্দোলন এ অবস্থায় প্রবেশ  করেছে নতুন শতাব্দীতে - যখন কিনা গখগ-এর উচ্চতর উপলব্ধির প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক অগ্রসর অভিজ্ঞতা ও ধারণাগুলো থেকে বিনয়ের  সাথে ও সৃজনশীলভাবে শেখার প্রশ্ন এবং নতুন উচ্চতর স্তরে একটি সঠিক লাইন নির্মাণের প্রশ্নাবলী জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়েছে - যার ভিত্তিতে মাওবাদী আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগ্রামের সামগ্রিক পুনর্গঠন জরুরী। এভাবে আন্দোলন প্রবেশ করেছে তৃতীয় পর্বে।
চলমান পর্বটি, বলা যায়, বিগত শতকের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল, যখন আমাদের পার্টি গণযুদ্ধের এদেশীয় নির্দ্দিষ্ট লাইনের ক্ষেত্রে অতীত থেকে রাপচার শুরু করে এবং মাওবাদ সূত্রায়ন গ্রহণ করে - যদিও মাওবাদের উচ্চতর উপলব্ধির ক্ষেত্রে তখনো দুর্বলতা ছিল, এবং মাওচিন্তাধারার বদলে মাওবাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে নিছক সূত্রায়ন বদলের পশ্চাদপদ চেতনাও তাতে বেশ পরিমাণে বিরাজমান ছিল। এ পর্বটি অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিগত শতাব্দীর শেষ দিকে ও এ শতাব্দীর শুরুতে। তাই এখনি এ পর্বের উপর কোন চূড়ান্ত মূল্যায়ন টানার সময় আসেনি। তবে আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে মালেমা রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু নতুন অভিজ্ঞতার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।
এদেশে মালেমা প্রয়োগের অতীত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে ( যার মাঝে গুরুতর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে ) পার্টির মাতদর্শের মত করে তুলে ধরার একটা ধারা অতীত থেকেই এখানে বিরাজমান ছিল, যা এখন নতুন রূপে দেখা যাচ্ছে। এটা মালেমা-এর ভিত্তিতে আমাদের আন্দোলনের সারসংকলনকে বাধাগ্রস্থই শুধু করে না, খোদ মালেমা-কেও দুর্বল করে দেয়। এমনকি অজান্তে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে নিয়ে আসে।
আমাদের দেশের অতীত মাওবাদী আন্দোলনে বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষেত্রে শুধু সশস্ত্র রূপের উপর একতরফাবাদী জোর প্রদানের বিচ্যুতি এখন এমন কিছু তত্ত্বগত লাইনে নিজেকে প্রকাশ করছে যা স্থূলভাবে মালেমা-কে সশস্ত্র সংগ্রাম বা গণযুদ্ধের অধীনস্থ করে ফেলে। অর্থাৎ, সশস্ত্র সংগ্রামকেই মালেমা-বাদী মূল্যায়নের একমাত্র মানদন্ড করে ফেলে। এভাবে মালেমা-কে গুরুতরভাবে দুর্বল করে ফেলে।
এদেশের মাওবাদী আন্দোলনে ঘাঁটি-প্রশ্নে ঐতিহাসিক দুর্বলতা এখন কোন কোন পক্ষ থেকে ভিন্নরূপে প্রকাশ পাচ্ছে , যখন দীগযু-এর সাথে অভ্যুত্থানের সমন্বয়ের সঠিক নীতির ভুল উপলব্ধি এলাকাভিত্তিক ক্ষমতাদখলের মূলগত লাইন থেকে সরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রেও মালেমা রক্ষার প্রশ্নটি প্রকাশিত হচ্ছে দীগযু-এর মাওবাদী  তত্ত্বের সমর্থনের মধ্য দিয়ে।
মালেমা ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার পক্ষাবলম্বনের নামে এদেশের উপযুক্ত মূর্ত-নির্দ্দিষ্ট লাইন নির্মান, এবং মালেমা ও বৈদেশিক অভিজ্ঞতার সৃজনশীল প্রয়োগের  অর্থাৎ, এগুলোকে দেশীয় পরিস্থিতির সাথে ফিউশন ঘটাবার  জন্য বাস্তব বিপ্লবী সংগ্রামকে কার্যত নেতিকরনের একটা ধারাও বিরাজমান। এটা মালেমা রক্ষার সংগ্রামকে অবনমিত করে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী  তত্ত্বালোচনায়।
এছাড়া, একদিকে মাওবাদের পক্ষাবলম্বন, আর অন্যদিকে সনাতন অর্থনীতিবাদী-সংস্কারবাদী বিচ্যুতিকে বহন করে চলা - এমন একটি ধারাও বিরাজমান - যা আমাদের মত দেশে যত দ্রুত সম্ভব গনযুদ্ধ সূচনা করাকে রননৈতিক প্রশ্ন হিসেবে এখনো কার্যতঃ আয়ত্ত করতে পারেনি।
সংশোধনবাদী ধারাগুলো - যেগুলো এখন এদেশে তত্ত্বগতভাবে ও বস্তুগত শক্তিতে দুর্বল এবং বুর্জোয়া লেজুরবৃত্তির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উন্মোচিত - তাদেরকে সংগ্রামের পাশাপাশি উপরোক্ত বিচ্যুতিগুলোকে সংগ্রাম করাটা মাওবাদ রক্ষার জন্য এখন গুরুত্বপূর্ন।
*
বিগত সময়কালে এদেশের গখগ-রংঃ আন্দোলনে মাওবাদকে রক্ষা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তথা বিপ্লবী লাইন বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতার কিছু সারসংক্ষেপ নিুোক্তভাবে করা যায় --
আমরা যখন গখগ-এর রক্ষার কথা বলি, তখন তার সঠিক উপলব্ধি হলো প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ উপলব্ধি ছাড়া তার প্রয়োগ সম্ভব নয়। গখগ-কে গ্রহণ করার কথা বলা, আর গখগ-রংঃ হওয়া এক কথা নয় - যা প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু এই উপলব্ধি আবার জড়িত তার প্রয়োগের সাথে। এর অর্থ হলো বিপ্লবী অনুশীলনের মধ্য দিয়েই শুধু মতবাদের উপলব্ধি গভীর থেকে গভীরতর হতে পারে এবং তাকে রক্ষা করাও সম্ভব হয়। গখগ  হলো প্রথমতঃ বিপ্লবের বিজ্ঞান, এবং মাও-এর ভাষায়, নাশপাতি খেয়েই শুধু নাশপাতির ¯^দ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা যায়; অর্থাৎ, বিপ্লব করেই শুধু বিপ্লবের মতবাদ গখগ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা যায়। এবং তাকে রক্ষা করা যায়।
বাংলাদেশের মাওবাদী আন্দোলনে মাওবাদের উপলব্ধি ও রক্ষায় তারাই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, যারা তার প্রয়োগের বিপ্লবী অনুশীলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বিপ্লবী অনুশীলন না করে, তার সাথে তত্ত্বকে সংযুক্ত না করে, তার প্রয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত না করে গখগ-এর উপলব্ধি ও সুরক্ষা হতে পারে না। কিন্তু এ সম্পর্কে একটি যান্ত্রিক ও একতরফাবাদী ধারনা, প্রবণতা , বিচ্যুতি ও ধারা এই দেশের বিপ্লবী মাওবাদী আন্দোলনে ঐতিহাসিকভাবে বিরাজমান - যা এখনো প্রবল। লাইন আছেই, সমস্যা শুধু প্রয়োগে - এমন ধারার স্থুল প্রয়োগবাদ লাইনের গতিশীলতাকে বাস্তবিকপক্ষে বাতিল করে দেয়। ফলে লাইনের বিকাশকে রুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে গখগ-রক্ষার কাজকে দুরুহ করে তোলে। লাইনের বিকাশ হলো অভিজ্ঞতার সারসংকলন ও সংশ্লেষণের কাজ। যা তত্ত্বগত কাজের গুরুত্বকে নিয়ে আসে। সুতরাং গখগ-রক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্বগত কাজের গুরুত্ব অপরিসীম - যা এদেশের মাওবাদী আন্দোলনে বিভিন্ন ধারার মাঝে ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত থেকেছে। নিজেদের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে লাইনকে বিকশিত করা, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া এবং তত্ত্বগত অধ্যয়ন-গবেষণাকে গভীর করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা উপরোক্ত সমস্যার সাথে যুক্ত।
গখগ-এর প্রয়োগ সৃজনশীল ; তা যান্ত্রিক বা গোড়ামীবাদী নয়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজগলো পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন - তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিসংস্কৃতি, ভ ূগোল - এগুলো পৃথক; এবং সময় নিয়ত বহমান - যার সাথে সাথে প্রতিটি সমাজ আবার নিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই, গখগ-এর বিশ্বজনীন সাধারণ মতবাদকে বিভিন্ন দেশে সৃজনশীলভাবেই শুধু প্রয়োগ করা যায়। এভাবে দেশে দেশে বিপ্লবী প্রয়োগের মধ্য দিয়ে গখগ বিশেষ রূপ ধারন করে - যার কথা মাও বলেছিলেন - যা সংশ্লিষ্ট দেশে বিপ্লবের বিশিষ্ট কর্মসূচী, রণনীতি, কৌশল - প্রভৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের মাওবাদী আন্দোলনে - অন্য সব দেশের মতই - গোড়ামীবাদ গখগ-এর বড় ক্ষতি করেছে। গোড়ামীবাদী ধরনে গখগ-এর রক্ষার চেষ্টা তাতে ব্যর্থ হয়। এই ধারাটি বিপ্লবী অনুশীলনের বিশিষ্টতার সাথে তত্ত্বের সংমিশ্রণ ঘটায় না। ফলে তত্ত্বের/ গখগ-এর সাধারণ আলোচনা হয় বাস্তব বিচ্ছিন্ন - যা নির্দিষ্ট বিতর্কের কোন মীমাংসা করেনা এবং কখনই উচ্চতর কোন সংশ্লেষণ ঘটায় না। এভাবে এটা লাইনের বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়।
কিন্তু গখগ-এর সৃজনশীল প্রয়োগ অবশ্যই জটিল ও কষ্টসাধ্য। তা গখগ-এর নীতি থেকে বিচ্যুতির ঝুঁকিও সৃষ্টি করে - যা আবার গখগ-রক্ষার সংগ্রামে একটা মৌলিক সমস্যা হিসেবে সর্বদাই বিরাজ করে।
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, গখগ-এর রক্ষা গখগ-এর সঠিক উপলব্ধির সাথে যুক্ত, আর গখগ-এর উপলব্ধি তার সৃজনশীল প্রয়োগের সাথে যুক্ত। গখগ-এর রক্ষা, আর তার সৃজনশীল প্রয়োগ একটা দ্বন্দ্ব। এর সঠিক মীমাংসা গখগ-রক্ষা ও তার বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গোড়ামীবাদী ও যান্ত্রিকভাবে গখগ-কে রক্ষা করা যায় না , আবার গখগ-এর মূলনীতি থেকে সরে গিয়ে তার সৃজনশীল প্রয়োগ হয় না। সুতরাং, গখগ-কে রক্ষা ও প্রয়োগের জন্য তার মূলনীতিকে জানা ও তার পক্ষাবলম্বন করা, বিপ্লবী অনুশীলনের সাথে এই সব তত্ত্বকে সংযুক্ত করা এবং বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তার সৃজনশীল বিকাশ সাধন হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 
এই পর্যন্ত এসে যে সমস্যা উদ্ভূত হয় তাহলো গখগ-এর নীতি বলবো কাকে - যা থেকে বিচ্যুতির অর্থ  গখগ থেকেই বিচ্যুতি ? আর কাকেই-বা বলবো তার সৃজনশীল প্রয়োগ ও বিকাশ। এ দুয়ের মাঝে বিতর্ক অন্তহীন যা বিশ্ব বিপ্লবের বিকাশ ও কমিউনিজমে উপনীত হবার মাধ্যমেই শুধু মীমাংসা হতে পারে। এখানে  গখগ-এর বিকাশ সাধনের প্রশ্নে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সংক্ষেপে কিছু ধারনা তুলে ধরতে পারি।
 * গখগ হলো বিজ্ঞান, বিপ্লবের বিজ্ঞান - যা অন্য সব বিজ্ঞানের মতই বিকাশশীল। বাস্তবে বিকাশ না ঘটিয়ে গখগ বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসেবে তার জীবন্ত চরিত্র বজায় রাখতে পারে না। এ কারণেই মার্কসবাদ এক সময়ে গখ-এ বিকশিত হয়েছে, এবং পরে বিকশিত হয়েছে গখগ-এ। সুতরাং, মাওবাদী হিসেবে যা আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে তাহলো গখগ বিকশিত হতে বাধ্য - বিশ্ব বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় ও তার প্রয়োজনে - প্রথমতঃ বিশ্ব বিপ্লবের নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে ; দ্বিতীয়তঃ অতীতের সর্বহারা বিপ্লবগুলোর সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও বিচ্যুতির সারসংকলনের মধ্য দিয়ে। যে দুটো আবার একটা অপরটির সাথে যুক্ত সমস্যা।
কিন্তু গখগ-কে রক্ষার প্রধান সমস্যা তার যথার্থ উপলব্ধি ও সঠিক প্রয়োগের সমস্যা, তার বিকাশের সমস্যা নয় -যদিও তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক। গখগ বিকাশের জন্য আমরা বিপ্লব করি না, বরং বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গখগ বিকশিত হয়। অর্থাৎ গখগ-কে বিকশিত করে তারপর বিপ্লব করি না, বরং  গখগ-এর ভিত্তিতে বিপ্লব শুরু করি এবং বিপ্লবের প্রয়োজনে, বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে গখগ বিকশিত হয়। অবশ্য গখগ-এর এ বিকাশ স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঘটে না, আপনাআপনিই হয় না। বিপ্লবের অভিজ্ঞতার সারসংকলন ও সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে, কষ্টসাধ্য চিন্তা-গবেষণা-বিতর্কের প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু যা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বিপ্লবের সমস্যা সমাধানে শুধুমাত্র গখগ-এর প্রয়োগই তার বিকাশ ঘটতে পারে। কারণ আমরা যখন গখগ-এর বিকাশের কথা বলি, তখন গখগ-এর কথাই বলিঅন্য কিছুর নয়।
কিন্তু, পূর্বেই যা আলোচনা হয়েছে, আর আমাদের দেশের মাওবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও হলো এই যে, লাইনের বিকাশ ছাড়া বিপ্লবী লাইনকে রক্ষা করা যায় না। রক্ষা ও বিকাশ একটা দ্বন্দ্ব - যার সঠিক মীমাংসার উপরই নির্ভর করে লাইনের সঠিক বিকাশ হবে ও তার মাধ্যমে বিপ্লব রক্ষা হবে, নাকি বিকাশের নামে বিপ্লব থেকে বিচ্যুতি সৃষ্টি হবে ও শেষ পর্যন্ত বিপ্লব ব্যর্থ হবে। গখগ-এর বিশ্বজনীন মতাদর্শের ক্ষেত্রে একই কথা খাটে। গখগ-এর বিকাশই গখগ-কে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু সে বিকাশ কীভাবে ঘটতে পারে ও আমরা কীভাবে তাকে দেখবো সেই প্রশ্নের মীমাংসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিকাশের সমস্যা আর নীতি থেকে বিচ্যুতির সমস্যা প্রায়ই বিভ্রান্তিকর।
গখগ-এর নীতির বিষয়টা কী ? এটা এক ব্যাপক ও জটিল বিষয়, এবং সর্বদাই এক উর্বর বিতর্কের ক্ষেত্র। তা সত্ত্বেও তার  মূল ভিত্তিটা হলো গুরুত্বপূর্ণ - যা তার সকল নীতির উৎস। গখগ হলো সর্বহারা বিপ্লবের বিজ্ঞান যার দর্শন হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। সুতরাং গখগ-এর অখন্ডনীয় মূল নীতি হলো বিশ্ব ব্যাপী শ্রেণীহীন  সমাজ কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। সর্বহারা বিপ্লব একটি বিশ্ব বিপ্লব, সর্বহারা শ্রেণী হলো আন্তর্জাতিক শ্রেণী, বিশ্বব্যাপী যার স্বার্থ অভিন্ন ; সুতরাং আন্তর্জাতিকতাবাদ - আদর্শে, রাজনীতিতে ও সংগঠনে - হলো তার মতাদর্শের মৌলিক উপাদান। এবং যেহেতু গখগ বিপ্লবের বিজ্ঞান, তাই তা বলপ্রয়োগ তথা বিপ্লবী একনায়কত্বের নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এইসব মূল নীতির মীমাংসা অবশ্যই সরল নয়। বিগত দেড়শবছরের বেশী সময় ধরে মার্কসবাদ বিকশিত হয়েছে অসংখ্য ভূল চেতনা, ধারনা, নীতি, কৌশল - প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ,যা কেন্দ্রীভূত হয়েছে চুড়ান্তভাবে তত্ত্বগত সংগ্রামে। সুতরাং এই সুদীর্ঘ সময়কালে মার্কসবাদের ভান্ডার স্ফীত হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব দ্বারা- যা গখগ-এর নীতিগত ভিত্তিকে স্থাপন করেছে। তাই, গখগ-এর রক্ষা মানে তার মৌলিক তত্ত্বাবলীর সমর্থন ও পক্ষাবলম্বন করা ও তার ভিত্তিতে গখগ-কে বিকশিত করা।
কিন্তু তত্ত্বও শ্বাশত নয় ; বহু তত্ত্ব চুড়ান্ত নয় এবং তত্ত্বও বিকাশশীল। অনেক আপাতঃ সঠিক তত্ত্ব সময় ও পরিস্থিতির বিকাশের মধ্য দিয়ে ভেঙ্গে পড়ে। তার মূলগত দৃষ্টিভঙ্গির স্বার্থে তাকে বদলে নিতে হয়। অন্যদিকে মূলগত সঠিক তত্ত্বাবলীতে অসম্পূর্ণতা থাকে, এমনকি কখনো কখনো কিছু কিছু ভূল উপাদান যুক্ত থাকে। তাই নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি  হয়ে  গখগ-এর ভান্ডারকে শুধু স্ফীতই করে না, সময়ে সময়ে তা পুরনো তত্ত্বকে ঘবমধঃব করে উচ্চতর স্তরে মূলগত তত্ত্বকে উন্নীত করে।
তাই, গখগ-এর বিকাশের প্রশ্নে মাওবাদীদেরকে অবশ্যই মাথা থেকে বোঝা নামিয়ে যন্ত্রটাকে চালু করতে হবে” - মাও যেমনটা শিখিয়েছেন। বিপ্লবী মাওবাদীদেরকে চিন্তার ক্ষেত্রে অবশ্যই সাহসী হতে হবে, গবেষণা-বিতর্ক চালাতে অগ্রণী হতে হবে - সর্বহারা বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়া ও তার সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনকে সামনে রেখে। বিপ্লবী লাইন, তত্ত্ব, মতবাদ সেটাই যা সর্বহারা শ্রেণীর আন্তর্জাতিক স্বার্থকে ও সর্বহারা শ্রেণীর বিশ্ব বিপ্লবকে এগিয়ে দেবে - যার মীমাংসা তত্ত্বগত বিতর্ক-সংগ্রামে প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন করতে হলেও এর চুড়ান্ত সমাধান সম্ভব বিপ্লবী অনুশীলনের অগ্নি পরীক্ষায়।
সাম্রাজ্যবাদের যুগে সর্বহারা বিপ্লব রূপ নিচ্ছে দেশ-ভিত্তিক। তাই, বিশ্ব বিপ্লবের অংশ হিসেবে চালিত নির্দিষ্ট দেশের বিপ্লব পরিচালনার মধ্য দিয়েই গখগ-এর বিকাশের কাজ শুরু হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট দেশের বিশিষ্ট অভিজ্ঞতা, আর আন্তর্জাতিকতাবাদী মতাদর্শ গখগ এক নয়। এক্ষেত্রেও একটা দ্বন্দ্ব বিরাজমান। গখগ হলো আন্তর্জাতিক চরিত্র সম্পন্ন মতবাদ ও মতাদর্শ। সুতরাং বিশিষ্ট অভিজ্ঞতা এই সাধারণ মতাদর্শকে কীভাবে বিকশিত করে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ থেকে সাধারণীকরণ একটা সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার - যা সংশ্লেষণ ও সাধারণীকরণের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই শুধু এগোতে পারে।
অন্যদিকে আমাদের মতবাদ, গখগ  জাতীয়ভাবে বিকশিত হতে পারে না, কারণ তা আন্তর্জাতিক - এবং আন্তর্জাতিক পরিসরের সাধারণ তত্ত্ব আকারে বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত তা নির্দিষ্ট কোন দেশের জন্য শুধু দেশজভাবেও বিকশিত হতে পারে না। এটা সরাসরিই আমাদের মতাদর্শের আন্তর্জাতিকতাবাদী চরিত্রের সাথে যুক্ত।
প্রতিটি সফল বিপ্লবে গখগ-এর সৃজনশীল প্রয়োগ বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও অস্ত্রভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু এমনটা হলেই আন্তর্জাতিক তাৎপর্যসম্পন্ন সাধারণ শিক্ষা আসবেই তার কোন কথা নেই। আর আন্তর্জাতিক তাৎপর্যসম্পন্ন কিছু কিছু শিক্ষা তা আনলেও অবধারিতভাবে তা আমাদের বিশ্বজনীন মতাদর্শের বিকাশ ঘটায় না। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোন দেশে গখগ-এর সৃজনশীল প্রয়োগ অথবা তা থেকে উদ্ভুত আন্তর্জাতিক তাৎপর্যসম্পন্ন কিছু কিছু শিক্ষা - আর গখগ-এর বিকাশ এক কথা নয়। কারণ, গখগ হলো বিশ্বজনীন সর্বহারা মতাদর্শ যা তার তত্ত্বাবলীর মধ্যে প্রকাশিত। তাই, গখগ-এর বিকাশ বলতে বোঝায় এ তত্ত্বাবলীর ক্ষেত্রে বিকাশ যা গুণগত চরিত্রসম্পন্ন। নতুন তত্ত্বগত অবদানগুলো গখগ-কে সমৃদ্ধ করতে যে ভূমিকা রাখে তাকে গখগ-এর প্রেক্ষিতে পরিমানগত বিকাশ বলা যেতে পারে। কারণ এমন কিছু কিছু অবদান সত্ত্বেও গখগ সাথে সাথেই নতুন স্তরে উন্নীত হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সমগ্রভাবে - তার তিনটি মূল ক্ষেত্রেই গুণগত নতুন স্তরে উন্নীত না হচ্ছে।

* ’
৭৬ সালে বিশ্বব্যাপী কমিউনিষ্ট আন্দোলন বিপর্যস্ত হবার পর থেকে প্রায় ৩০ বছর পার হয়ে গেছে যখন বিশ্বে কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ নেই। ৬০/৭০-দশকের বিপ্লবী আন্দোলনের সামগ্রিক বিপর্যয়ের পর বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিগত সময়ে বহুবিধ পরিবর্তন ঘটেছে।  যার মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর মাঝে রয়েছে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী ব্লকের পতন এবং মার্কিনের নেতৃত্বে প্রায় একক সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের উদ্ভব, বিশেষতঃ বিশ্বায়ন”, “উদারীকরণবিরাষ্ট্রীয়করণ”-এর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ, কম্পিউটারসহ প্রযুক্তি, যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার বিরাট বিকাশ ও পরিবর্তন প্রভৃতি। এসব কিছু সাম্রাজ্যবাদের ঋঁহপঃরড়হরহম, তৃতীয় বিশ্বের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, বিপ্লবের রণনীতি ও কৌশল প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন নতুন চিন্তা বিপ্লবী মাওবাদীদের মাঝে নিয়ে এসেছে।

আমাদেরদেশে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ, প্রযুক্তির বিকাশ, শ্রেণীসমূহের পরিবর্তন ওকৃষিতে রূপান্তরের সমস্যাগুলোর প্রেক্ষিতে আমাদের পার্টি আমাদের কৃষিসহসমগ্র অর্থনীতিকে আধা-সামন্ততান্ত্রিক’-এর বদলে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর বিকৃতপুঁজিবাদী বলে চিহ্নিত করছে  যা মাওবাদী আন্দোলনে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টিকরেছে। এটা সত্য যে, এই লাইনগত অবস্থানকে আমরা এখনো ভাল তত্ত্বগত ভিত্তিতেস্থাপন করতে পারিনি; কিন্তু আমাদের পার্টি মনে করে যে, সনাতন মাওবাদী লাইনঅনুযায়ী প্রধান দ্বন্দ্ব ( সামন্তবাদী ভুস্বামী শ্রেণীর সাথে কৃষকেরদ্বন্দ্ব), গ্রামাঞ্চলের শ্রেণী-বিন্যাস (বিশেষতঃ সামন্তবাদী ভূস্বামীশ্রেণী)  ও কর্মসূচীর প্রধান বিষয় (সামন্তবাদী ভূস্বামীদের জমি কেড়ে নেয়া ওকৃষকের মাঝে তা বন্টন) - এ সবের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে।যদিও আমরা মনে করি যে, বিপ্লবের স্তর নয়াগণতান্ত্রিক, গ্রাম প্রধানক্ষেত্র, কৃষক প্রধান শক্তি এবং খোদ কৃষকের হাতে জমি’-র নীতি - এ বিষয়গুলোঅব্যাহত থাকতে হবে।  আমাদের দেশে ও বিশ্বব্যাপী মাওবাদী আন্দোলনে এপ্রশ্নে চুড়ান্ত উপসংহার ভবিষ্যতে যা-ই হোক না কেন, এদেশের মাওবাদীআন্দোলনে খুব জোরালোভাবে এই অভিমত ব্যক্ত হচ্ছে যে, ৪০-দশকের চীন বা৬০-দশকের ভারতবর্ষের মত পরিস্থিতি এখন বিরাজ করছে না ; এবং কৃষিসহ সমগ্রঅর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ ও তার ফলে সৃষ্ট রূপান্তরগুলোকেঅত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে (যা সাম্রাজ্যবাদেরবিশ্বব্যাপী ফাংসানিং-এর সাথে যুক্ত ) এবং মাওবাদী লাইনকে উচ্চতর স্তরেউন্নত করতে হবে।
তেমনি, রণনীতির প্রশ্নেও এদেশের মাওবাদীদের মধ্যে যেআলোচনা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক পরিসরে গবেষণা ও বিতর্কগুলোর সাথে যুক্ত।এমনকি ষাট-সত্তর দশকেই ক. ঈগ ও ক. ঝঝ গ্রাম-শহরে যুগপৎ সশস্ত্র সংগ্রামেরকথা বলেন ও প্র্রয়োগ করেন। ক. ঝঝ দেশব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রাম ও সশস্ত্রহরতালকে প্রয়োগ করেন এবং সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থানের কথা জোরালোভাবে তুলে ধরেন।অবশ্য সে সময়ে-তো বটেই, এমনকি বিগত শতাব্দীর শেষাংশ পর্যন্ত সুদীর্ঘকালেরমাওবাদী সংগ্রামে ঘাঁটি এলাকার প্রশ্নটি এদেশে উপেক্ষিত থেকেছে - যা এদেশেএকটা সফল গণযুদ্ধ গড়ে না ওঠার জন্য বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে আমরা এখনমনে করি। তা সত্ত্বেও গ্রাম-শহরে যুগপৎ সশস্ত্র সংগ্রাম, দেশব্যাপীগণযুদ্ধ, জাতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ও কৌশলগত কর্মসূচী, দীর্ঘস্থায়ীগণযুদ্ধের সাথে অভ্যূত্থানকে সংযুক্ত করা - প্রভৃতি বিষয়কে আমরা খুবইগুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এসব ক্ষেত্রে নেপাল-গণযুদ্ধের অভিজ্ঞতাগুলোকেআমরা খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করি। আমাদেরও ধারনা হলো এই যে, চীনেরঅভিজ্ঞতাকে পড়হংবৎাধঃরাবষু ও ঃৎধফরঃরড়হধষষু গ্রহণ করলে ও প্রয়োগ করলে আজকেরপরিবর্তিত অবস্থায় বিপ্লবকে সফলতার সাথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না - যদিওদীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ (চচড) ও গ্রামে ঘাঁটি - একে আমরা রণনীতি হিসেবেসুদৃঢ়ভাবে বজায় রাখতে চাই। তবে উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে তার বিকাশ প্রয়োজন।উপরন্তু আমাদের পার্টি দৃঢ়ভাবে মনে করে যে, এই বিকাশটা জড়িত ৩য় বিশ্বেসাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ ও তার ফলে আর্থ-সামাজিক নতুন রূপান্তরগুলোর সাথে - কম্পিউটার, প্রযুক্তি এগুলো হলো  যার কিছু প্রকাশমাত্র। যদিও অর্থনীতিকেআধা-সামন্ততান্ত্রিকনা সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর বিকৃত পুঁজিবাদীবলা হবেতা বিতর্কিত। উপরে আলোচিত বিষয়গুলো ছাড়াও যে মৌলিক সমস্যা আজ বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীর দরজায় কড়া নাড়ছে তাহলো সর্বহারা একনায়কত্বের প্রশ্ন। নেপালে আজ সর্বহারা বিপ্লব বিজয়ের বাস্তব সম্ভাবনা সৃষ্টি  হয়েছে, যা কিনা সুদীর্ঘকাল পর পুনরায় সর্বহারা একনায়কত্বের অভিজ্ঞতায় বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণীকে নিয়ে যেতে পারে। বিগত শতকে সর্বহারা একনায়কত্বাধীনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে মহান গৌরবময় ও বিশাল অগ্রগতি সত্ত্বেও খুব বেশী সময় পার না হতেই, বিশেষতঃ প্রধান নেতৃত্বের অনুপস্থিতি মাত্র বিপ্লবগুলোতে পরাজয়ের সারসংকলনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এচঈজ-কালে মাও যার সূচনা করেছিলেন তাকে অবশ্যই এগিয়ে নিতে হবে ও বিকশিত করতে হবে। কিন্তু এ বিকাশের প্রশ্ন গখগ-এর, বিপ্লবের তথা সর্বহারা একনায়কত্বের, ও সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের ; এর বিপরীত কিছুর নয়।
*
সুতরাং বোঝামুক্ত মাথা দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন অবশ্যই বিপ্লবী মাওবাদীদের হতে হবে। মাও বলেছিলেন, মার্কসবাদ হলো ডৎধহমষরংস। মাওবাদী হিসেবে সর্বহারা বিশ্ব বিপ্লবের প্রয়োজনে নতুন সব প্রশ্নে বিতর্ক চালাতে অবশ্যই সাহসী হতে হবে। আর এর মধ্য দিয়েই বিপ্লবের লাইন বিকশিত হবে, বিপ্লব বিজয়ী হবে ও এগিয়ে যাবে,এবং আমাদের মতাদর্শেরও বিকাশ ঘটবে। নিশ্চয়ই তত্ত্বগত কাজকে  এগিয়ে নিতে হবে, তত্ত্বেরও বিকাশ ঘটবে। কিন্তু তা করতে হবে মার্কসবাদের মূলগত তাত্ত্বিক ভিত্তিতে দাড়িয়ে, দেড় শতাব্দীর কমিউনিস্ট বিপ্লবের বিপুল রক্তে-ঘামে কেনা মূল্যবান ও ঐতিহাসিক শিক্ষাকে রক্ষা করে। মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ বা তার বিকাশের কথা বলে প্রায়ই তার মূলগত সত্যই বর্জিত হয় - বা তার থেকে বিচ্যুতি গড়ে ওঠে যা পরবর্তীকালে বিপ্লব বর্জনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে । এটা মার্কসবাদের দেড়শবছরের ইতিহাসে অসংখ্যবার দেখা গেছে। বাংলাদেশের মাওবাদী আন্দোলনেও বহুবার দেখা গেছে যে, লাইনের ভূল সংশোধনের নামে বিপ্লবকে বর্জন করা হয়েছে। আবার লাইনকে বিকশিত না করে বিপ্লবকে রক্ষা করা যায়নি, বরং তা গোড়ামীবাদ হয়ে সংস্কারবাদ বা অনুশীলন-বিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবী তত্ত্বালোচনায়, এমনকি স্থুল সংশোধনবাদে পরিণত হয়েছে। তাই, এই দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসা অত্যধিক গুরত্বপূর্ণ। আর তা করা সম্ভব সর্বহারা শ্রেণী-স্বার্থ ও শ্রেণী-চরিত্র, সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ, বিপ্লব তথা সর্বহারা একনায়কত্ব এবং বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের চুড়ান্ত লক্ষ্য থেকে কোনভাবেই বিচ্যুত না হয়ে। আর তেমন কিছু ঘটলে তা দ্রুত সংশোধন করার বিনয়ী ও সাহসীআত্মপর্যালোচনামুখী ও আত্মসমালোচনামুখী মনোভাবকে ও মেথডলজিকে বিকশিত করে।
বিশ্ব নিয়ত পরিবর্তনশীল। তার সাথে মিলিয়ে তত্ত্বেরও প্রতিনিয়ত বিকাশ ও উন্নয়ন প্রয়োজন। যা সম্ভব বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের স্বার্থে বিশ্বকে রূপান্তরের সংগ্রামে অংশ নিয়ে, অভিজ্ঞতার মার্কসবাদী সারসংকলন করে এবং তাকে পুনরায় প্রয়োগে নিয়ে গিয়ে। এ প্রক্রিয়ায় বহুবার আবর্তনের পরই শুধু নির্দিষ্ট জ্ঞান সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে। 
-নভেম্বর, ’০৪।।

No comments: