নোটঃ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি/সিসি (পিবিএসপি/সিসি) সম্পাদক
আনোয়ার কবীরের রচনা সংকলন প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। সেই সংকলনের প্রথম খন্ডের প্রথম অধ্যায় থেকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ওয়েভসাইটে দেয়া হলো।
ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক পর্যালোচনা
মাওবাদী আন্দোলনের সূচনা ও প্রথম পর্ব-
৬০/৭০-দশক (ভিত্তি পর্ব)
(নভেম্বর, ২০১১)
৬০-দশকের প্রথমার্ধে সোভিয়েত-ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদের
বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানমাও-এর নেতৃত্বাধীন চীনা পার্টির মতাদর্শগত মহাবিতর্কের
প্রভাবে এদেশে সর্বপ্রথম মাওবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। দশকের শেষার্ধে মাও
সেতুঙের নেতৃত্বে সূচিত ও পরিচালিত চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব
(জিপিসিআর) এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নক্সালবাড়ী এলাকায় কমরেড চারু মজুমদারের
নেতৃত্বে মাও চিন্তাধারা অনুসারী বিপ্লবী সশস্ত্র কৃষক-অভ্যুত্থান- এই দু’য়ের প্রভাবে এদেশে
মাওবাদী আন্দোলনের স্বতন্ত্র বিকাশের সূত্রপাত ঘটে। সে সময় পূর্ব বাংলা
পাকিস্তানের অন্তর্গত একটি প্রদেশ ছিল, যা সরকারিভাবে “পূর্বপাকিস্তান” নামে পরিচিত ছিল। পূর্বপাকিস্তান
ভিত্তিক আদি কমিউনিস্ট পার্টির (ইপিসিপি’র) প্রধান নেতৃত্বদের দ্বারা সোভিয়েত-ক্রুশ্চভীয়
সংশোধনবাদী পথ অনুসরণ করায় তার বিরুদ্ধে আন্তরিক কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা এক মহান
বিদ্রোহের সূচনা করেন। ষাট-সত্তর দশকে এই সংগ্রামের ন্যায্যতা ও সঠিকতা, এবং পাশাপাশি তার
দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও
বিচ্যুতিসমূহ মাওবাদী আন্দোলনের এই প্রথম পর্বের যাবতীয় লাইন, সংগঠন ও সংগ্রাম
জুড়ে ব্যাপ্ত ছিল। এটাই বিগত শতকের তথা প্রথম যুগের মাওবাদী আন্দোলনের
ভিত্তি স্থাপন করেছিল। সে কারণে এই ভিত্তি-পর্বের আলোচনাই সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ, যা কিনা আমাদেরকে
বিগত প্রথম যুগটির সামগ্রিক সারসংকলনের কাজে সক্ষম করে তুলতে পারে।
এই সংগ্রামের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক ছিল এই যে, এই সংগ্রাম সর্বহারা
শ্রেণির মতবাদ হিসেবে তার সর্বশেষ বিকশিত স্তর বা তৃতীয় স্তর, অর্থাৎ, মাও সেতুঙ
চিন্তাধারাকে (মাওবাদকে) এ দেশে নিয়ে আসে এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করে- শুধু তাত্ত্বিক
ক্ষেত্রেই নয়, জনগণের বাস্তব
বিপ্লবী সংগ্রামের গাইড হিসেবেও।
মাও চিন্তাধারা দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে এই আন্দোলন
বিপ্লবের স্তর হিসেবে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব, কৃষক ও গ্রামাঞ্চলকে ভিত্তি করা, সংসদীয় পথকে বর্জন
করা, বুর্জোয়া
লেজুড়বৃত্তিকে বর্জন করা,
এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পথকে আঁকড়ে ধরা- এই মৌলিক মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনকে মূলত
প্রতিষ্ঠিত করে।
রাজনৈতিক লাইনের এই সঠিকতাগুলোর ভিত্তিতেই ষাট-সত্তর দশকে
এক মহান বিপ্লবী উত্থান মাওবাদীদের নেতৃত্বে এদেশে ঘটেছিল, যা কিনা ’৭০ থেকে শুরু ক’রে ’৭৪- কম/বেশি এই পাঁচ বছর
ধরে ব্যাপ্ত ছিল। ৭০-দশকের প্রথমার্ধ জুড়ে চলা এই বিপ্লবী আন্দোলন এ
দেশের সমগ্র আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে জনগণের সবচেয়ে বিপ্লবী, সবচেয়ে সঠিক, সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত
শ্রেণি ও জনগণ আশ্রয়ী মুক্তি সংগ্রামের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। যাকে প্রায়শই এদেশের
অতীত ও সাম্প্রতিক ইতিহাসে জনগণের বিভিন্ন অংশের দ্বারা অথবা প্রতিক্রিয়াশীল
নেতৃত্ব দ্বারা চালিত বিবিধ প্রগতিশীল, সংস্কারমূলক, জাতীয়তাবাদী বা এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের
একতরফা ও বিকৃত, শাসকশ্রেণিয় ও
মধ্যবিত্ত সংস্কারবাদী বর্ণনা দ্বারা এবং মিথ্যাচার, মূর্খতা ও অজ্ঞতা দ্বারা ঢেকে রাখা হয়। সুতরাং কমিউনিস্ট
আন্দোলন, বিশেষত মাওবাদী
আন্দোলনের একটি প্রধানতম দায়িত্ব হলো ইতিহাসের এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য
সার্বিক ভূমিকা রাখা।
এই আন্দোলনের প্রধানতম নেতৃত্বদেরকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। যার মাঝে প্রধানতম
সারিতে ছিলেন কমরেড সিরাজ সিকদার, বাদল দত্ত, মনিরুজ্জামান তারাসহ আরো অনেক নেতৃত্ব। যাদের মাঝে কমরেড
সিরাজ সিকদারকে সামগ্রিক বিবেচনায় সারির শীর্ষে রাখতে হবে বলেই আমরা মনেকরি।
একইসাথে সেসময়ে গুরুত্বপূর্ণ ও খুবই নির্ধারক ইতিবাচক
ভূমিকা পালন করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে
বিভিন্নভাবে পথচ্যুত হয়েছেন বা এমনকি অধপতিত হয়েছেন এমন বহু নেতৃত্বেরও তৎকালীন মাওবাদী
বিপ্লবী অবদানকে স্মরণে রাখতে হবে, এবং তাকে আমাদের আন্দোলনেরই সম্পদ বলে বিবেচনা করতে
হবে। সর্বজনাব হক-তোয়াহা-সুখেন্দু দস্তিদার, মতিন-আলাউদ্দিন-আমজাদ হেসেন-টিপু বিশ্বাস, রণো-মেনন, দেবেন
শিকদার-বদরুদ্দিন উমরসহ আরো অনেক জাতীয় পরিচিতি সম্পন্ন নেতৃত্বগণ মাওবাদী
আন্দোলনকে এদেশে প্রতিষ্ঠিত করায়, অথবা তার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপনে এই প্রথম উত্থান পর্বে
স্বল্প বা কিছুটা দীর্ঘ সময়ের জন্য, কিছুটা বেশি বা অল্প করে হলেও ইতিবাচক ভূমিকা
রেখেছিলেন। মাওবাদ সম্পর্কে ধারণার দুর্বলতা ও মতাদর্শগত
সংগ্রামের ঝড়ঝাপ্টায় এদের প্রায় সবাই আগে বা পরে কার্যত মাওবাদকে অনুশীলনে নিতে
ব্যর্থ হন, একসময়ে তাকে বর্জন
করেন, এমনকি এদের একাংশ
সরাসরি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিতেও অধপতিত হন। কিন্তু এই
নেতৃত্বগণের মাওপন্থী থাকার সময়কালকে এবং বিপ্লবী বা প্রগতিশীল ভূমিকাকে একইসাথে
তাদের পরবর্তীকালের অধপতিত ও ভুল রাজনীতির ফসল অথবা ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বলার কোন
কারণ নেই। ইতিবাচক ইতিহাসের এই পুনরুদ্ধার প্রতিক্রিয়াশীল
ইতিহাস মোকাবেলায় আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একে কোনক্রমেই বর্জন
করা যাবে না।
* এই পর্বের দেশীয়
আন্দোলন আলোচনায় কমরেড চারু মজুমদারের (CM- সিএম) মহান ভূমিকার
বিষয় কিছুটা হলেও উল্লেখ থাকা প্রয়োজন, যদিও তিনি প্রত্যক্ষভাবে এদেশের নয়, বরং ভারতের মাওবাদী
আন্দোলনের নেতা ছিলেন। এর কারণ হলো, নক্সালবাড়ী আন্দোলনটি ছিল আমাদের দেশের মাওবাদী
আন্দোলনের সমসাময়িক হলেও কিছুটা পূর্বসূরী। ফলে তার এক বিপুল
প্রভাব পড়েছিল এদেশের মাওবাদী আন্দোলনে। এমনকি আমাদের পার্টি
ছাড়া অন্য ধারাগুলোর অনেকগুলোই কম/বেশি সময়ের জন্য সিএম-শিক্ষাকে নিজ নিজ পার্টির
প্রায় তাত্ত্বিক ভিত্তির মত ক’রে অনুসরণ করেছিল। পূবাকপা-ধারাটি বিগত
শতক জুড়েই এটা করেছে। তাই, সিএম-আলোচনা ব্যতীত এই পর্বের মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ
থেকে যেতে বাধ্য।
কমরেড সিএম-এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মাঝে ছিল
জিপিসিআর-এর শিক্ষাকে আত্মস্থ করার সংগ্রাম গড়ে তোলা, অর্থনীতিবাদ-সংস্কারবাদের
বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মতাদর্শগত-রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করা, কৃষি-বিপ্লবের
প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসা,
গোপন বিপ্লবী পার্টি গঠনের এক সম্পুর্ণ নতুন ধারার প্রতিষ্ঠা করা, এবং
আন্তর্জাতিকতাবাদী মতাদর্শকে বিপুল উচ্চতায় উন্নীত করা। তিনি ভারতের মত এক
বৈরী দেশে বিপ্লবী ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঘোষণা করতে পেরেছিলেন, “চীনের চেয়ারম্যান
আমাদের চেয়ারম্যান”। কমরেড সিএম
দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের রাজনীতি ও গেরিলা যুদ্ধের রণনীতিকে আঁকড়ে ধরে শূন্য থেকে
সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার বিপ্লবী লাইন গ্রহণ ও প্রয়োগ করেছিলেন। এসমস্ত দ্বারাই
আমাদের দেশের বিপ্লবী মাওবাদীরা বিরাটভাবে অনুপ্রাণিত ও শিক্ষিত হয়েছিলেন। গণযুদ্ধের বিপ্লবী
রাজনীতি ও গেরিলা যুদ্ধের সামরিক লাইন প্রয়োগের জন্য তিনি “খতম লাইন” নামে সমধিক পরিচিত
যে লাইন প্রণয়ন করেন ও প্রয়োগ করেন তা-ও কম/বেশি পরিমাণে এদেশের সকল বিপ্লবী
মাওবাদী ধারাই গ্রহণ করেছিল- স্বীকৃতি দিয়ে বা না দিয়ে, সচেতন বা অসচেতনভাবে। গণযুদ্ধের রাজনীতি ও
গেরিলা যুদ্ধের সামরিক লাইন সংসদীয় পথকে চুরমার ক’রে কৃষকের বিপ্লবী গেরিলা যুদ্ধ, তথা গণযুদ্ধ আরম্ভ
করায় ভারত ও পূর্ব বাংলায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিল। যদিও সিএম-প্রণীত “খতম লাইন”-এর সফলতার পাশাপাশি
তার নিজস্ব দুর্বলতা ও সমস্যাও ছিল, যা আমরা পরে আলোচনা করবো। তাঁর সামগ্রিক
মূল্যায়ন আমরা এখানে করতে পারবো না। কিন্তু কমরেড সিএম-কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্যই তার
মৌলিক অবদানগুলো সম্পর্কে আন্দোলন ও জনগণের মাঝে সচেতনতা প্রয়োজন, কারণ, ৭০-দশকের মাওবাদী
আন্দোলনের প্রথম উত্থান পর্বকে কমরেড সিএম-এর আলোচনা ছাড়া, তাকে ঊর্ধ্বে তুলে
ধরা ব্যতীত করা সম্ভব নয়।
* কিন্তু এই সব সফলতা সত্ত্বেও এই আন্দোলন যে খুব
দ্রুতই সামগ্রিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তার কারণ শুধু শত্রুর বর্বর দমনের মাঝে খুঁজলে
চলবে না। বরং সেটা সে সময়কার লাইনের ভুলসমূহের মাঝেও নিহিত
ছিল। আমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, মাওবাদী আন্দোলন তার এ শৈশবাবস্থায় অনেক ঐতিহাসিক
সীমাবদ্ধতাযুক্ত থাকা স্বাভাবিক ছিল। আন্দোলন ছিল অপরিপক্ক। মাওবাদ আত্মস্থ করার
সময় সে পেয়েছিল খুবই কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্বলতা ও বিচ্যুতি- তা যে কারণেই ঘটুক
না কেন, তা আন্দোলনকে ক্ষতি
করতে বাধ্য, এবং তা জনগণের
বিপ্লবী আন্দোলনে বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে কাজ করতে বাধ্য। তাই, আমাদের উচিত হবে
কোনরকম মোহগ্রস্থ না হয়ে নিষ্ঠুরভাবে আমাদের আন্দোলনের সে সময়কার সমস্যাগুলোকে
উদ্ঘাটন করা।
** সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামে মৌলিকভাবে ইতিবাচক ভূমিকা
রাখা সত্ত্বেও ষাট-সত্তর দশকের এ সংগ্রামে গুরুতর অনেক দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল। ক্রুশ্চভীয়/ইপিসিপি
সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামকে আমাদের আন্দোলন সৃজনশীলভাবে এদেশীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের
সারসংকলনের সাথে মিলিয়ে একটি সামগ্রিকতায় পরিণত করতে পারেনি এবং তাকে বাস্তবে
সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এটাই প্রথমত তাকে অক্ষম করে তোলে একটি সামগ্রিক ও
সঠিক মাওবাদী লাইন বিনির্মাণে। এটা মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক- সবক্ষেত্রেই তার প্রভাব রাখে। যা কিনা বিগত শতকের
আন্দোলনে সমস্ত পর্যায়েই ধারাবাহিকভাবে কম/বেশি প্রভাব রেখেছে। আমরা এখন সেগুলোর
উপর সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক আলোচনা করবো। কারণ, এই দুর্বলতা ও বিচ্যুতিকে কাটানোর উপরই নির্ভর করবে
এখনকার এক নতুন যুগে একটি সামগ্রিক সঠিক লাইন বিনির্মাণ কাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়া।
“মতবাদিক/মতাদর্শিক ক্ষেত্র’’
ক) মতবাদের ৩য় স্তরে
বিকাশ প্রশ্নে উপলব্ধিতে ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতাঃ
আমাদের দেশের মাওবাদী আন্দোলন শুরু থেকেই মতবাদের তৃতীয়
স্তর হিসেবে মাওচিন্তাধারাকে গ্রহণ করলেও তার উপলব্ধিতে গুরুতর অসম্পূর্ণতা ও দুর্বলতা
ছিল, যার একাংশ ছিল
ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা উদ্ভূত।
জিপিসিআর-এর সূচনাতেই বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণির মতাদর্শ
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পরবর্তী মাওবাদের তৃতীয় স্তরে উন্নীত হলেও সাংস্কৃতিক
বিপ্লবের সমগ্রকাল জুড়ে তা আরো বিকশিত হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে বা
ভারতেবর্ষে যখন মাওবাদী আন্দোলন শুরু হয় তখনো জিপিসিআর মাত্র তার প্রথম লড়াইটি, অর্থাৎ লিউ শাওচি-বিরোধী
সংগ্রামটি সংঘটিত করেছে। এর দ্বিতীয় প্রধান লড়াই, অর্থাৎ, লিনপন্থার বিরুদ্ধে
সংগ্রামটির তাৎপর্য বুঝে উঠবার আগেই সিএম
শহীদ হন। সিএম-এর বিপ্লবী ধারাকে এগিয়ে না নেয়ার কারণে আমাদের
দেশেও তার তাৎপর্য আত্মস্থ হয়নি। আমাদের পার্টিতে
কমরেড সিরাজ সিকদারের শহীদ হবার অল্প আগে লিন-বিরোধী সংগ্রামের আলোচনা শুরু হলেও
সেটা তেমন কোন গভীরতা অর্জন করবার সময় পায়নি। আর তেংবিরোধী শেষ
লড়াইটি শুরুই হয় এই আলোচিত প্রথম পর্বটির সার্বিক বিপর্যয়ের পরে। সুতরাং জিপিসিআর
কালের সমগ্র শিক্ষাগুলো সমৃদ্ধ আকারে তখনকার মাওবাদী আন্দোলনের পক্ষে গ্রহণ করার
প্রশ্ন ছিল না।
কিন্তু যা কঠিন হলেও সম্ভব ছিল তাহলো স্ট্যালিনের
সারসংকলনকে আয়ত্ব করা, যা মাও ইতিপূর্বেই
সম্পন্ন করেছিলেন। বিশ্ব মাওবাদী আন্দোলনে আজ যা প্রায় প্রতিষ্ঠিত
বিষয় তাহলো মাও কর্তৃক স্ট্যালিনের সারসংকলন, যা কিনা মাওবাদ নির্মাণের পথে এক অপরিহার্য উপাদান
ছিল। বাস্তবে এর উপরই দাঁড়িয়ে ছিল মতবাদের মাওবাদে উলম্ফনের বিষয়টি। বিশ্ব কমিউনিস্ট
আন্দোলনের দুর্বল আন্তর্জাতিকতাবাদী যোগাযোগ মাওবাদের এই সব উপাদানকে হাতে পাবার
ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেছিল। যে কারণে, সামগ্রিকভাবে মাও-এর নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবকালের
অবদানগুলোই প্রধানত এদেশে তখন এসেছিল, যাকে ভিত্তি ক’রে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সঠিক ছিল বটে, কিন্তু তা আবার সেই
সংগ্রামকে দুর্বল করেও গড়ে তুলেছিল। আমাদের মাওবাদী আন্দোলনের গোড়াতেই এই সীমাবদ্ধতা
মাওবাদী আন্দোলনের ভিত্তিকে দুর্বলভাবে সৃষ্টি করে দেয়, যা বিগত শতকের গোটা
পর্যায়টিতে বিভিন্ন ধারার মাঝে বিভিন্ন মাত্রায় বিরাজ করেছিল। শুরু থেকে আমাদের মাওবাদী
আন্দোলনের দুর্বলতাগুলোর সাথে মতবাদের এই অসম্পূর্ণ ও দুর্বল উপলব্ধির গুরুতর
সম্পর্ককে না বুঝলে চলবে না।
খ) আদি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট সারসংকলন করার মধ্য
দিয়ে সংশোধনবাদের সাথে পরিপূর্ণ রাপচার
করতে না পারাঃ
ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদের যে লেজুড়বৃত্তি করার মধ্য দিয়ে
ইপিসিপি(মনিসিং নেতৃত্বাধীন)অতিসত্বর সংশোধনবাদে অধপতিত হয়ে যায়, তা হঠাৎ করে ঘটেনি; তার ভিত্তি আদি
কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেই বিরাজমান ছিল। কিন্তু আদি
কমিউনিস্ট আন্দোলন, আর ক্রুশ্চভীয়
সংশোধনবাদ হুবহু একই জিনিষ ছিল না; তাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। এদেশে কমিউনিস্ট
আন্দোলনকে নতুন ধারায় স্থাপিত করার জন্য ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদকে সংগ্রাম করার
পাশাপাশি আদি আন্দোলনের একটি মৌলিক, সুনির্দিষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ সারসংকলন
প্রয়োজন ছিল, যাকিনা তার সাথে
বিপ্লবী রাপচারকে সম্পূর্ণ করতে পারতো। এই প্রশ্নে নবউদ্ভূত মাওবাদী আন্দোলন গুরুতর
দুর্বলতা দ্বারা চালিত হয়েছে।
মাওবাদ-পূর্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন, যাকে আমরা আদি
কমিউনিস্ট আন্দোলন বলছি, তার সাথে বিপ্লবী
বিচ্ছেদ ব্যতীত কোন বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন এদেশে গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। বিশেষত যখন তা
মধ্য-পঞ্চাশ দশক থেকে আন্তর্জাতিক সংশোধনবাদের লেজুড়ে পরিণত হলো তখন তাকে পরিপূর্ণ
বর্জনের প্রশ্ন আক্ষরিকভাবেই সঠিক ছিল। কিন্তু সংশোধনবাদের লেজুড় হবার পূর্বে যখন পর্যন্ত
সে স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন ৩য় আন্তর্জাতিক বা কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত
ছিল তার গুরুতর লাইনগত ত্রুটি, এমনকি বহুবিধ সংশোধনবাদী উপাদান সত্ত্বেও, তার সাথে ক্রুশ্চভীয়
সংশোধনবাদী ধারার একটা মৌলিক পার্থক্যরেখা টানা গুরুত্বপূর্ণ ছিল- যা নব্য মাওবাদী
আন্দোলন করেনি, এবং কার্যত এ দুটোকে
একাকার করে ফেলেছিল। এর ফল হয়েছিল এই যে, আদি কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিবাচক ঐতিহ্যের রক্ষা
এবং তার ভুল লাইন, বা এমনকি সংশোধনবাদী
উপাদানসমূহের সুনির্দিষ্ট প্রকাশগুলোকে নির্দিষ্টভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট
আন্দোলনকে একটি নতুন উচ্চতর জায়গায় উন্নীত করবার সংগ্রাম ব্যাপকভাবে দুর্বল থেকে
যায়। আদি কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক ইতিবাচক ঐতিহ্যকেও এভাবে ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদের
অনুসারীদের পকেটে তুলে দেয়া হয়। এবং যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আদি আন্দোলনের
মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনের এক সুগভীর বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে
একটি গুরুতর দুই লাইনের সংগ্রাম বিকশিত করার বদলে ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদ বর্জনের ও
মাওবাদ গ্রহণের একটি সরল পথ অনুসৃত হয়।
* আগেই উল্লেখ করা
হয়েছে যে, আদি কমিউনিস্ট
আন্দোলন একটি প্রকৃত বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল। পূর্বাপর মূলত একটি
অর্থনীতিবাদী-সংস্কারবাদী ধারায় তা আটকে ছিল। লেনিনের “কী করিতে হইবে?” মতবাদ কখনই এই
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি আত্মস্থ করতে পারেনি। ঠিক এ কারণেই রাষ্ট্রক্ষমতা
দখলের বিপ্লবী সংগ্রাম থেকে এ পার্টি সর্বদাই দূরত্বে ছিল। তাই, কৃষকের আশু আন্দোলন
যখন স্বতঃস্ফুর্তভাবে সশস্ত্র পথে বিকশিত হয়ে ওঠে, এবং বহু অঞ্চলে নিজেদের বাহিনী গড়ে তোলার মাধ্যমে
রাজনৈতিক ক্ষমতা কার্যত দখল করে ফেলে (তেলেঙ্গানায়, অংশত তেভাগা আন্দোলনে), তখন পার্টি তাকে
নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থই শুধু হয় তা নয়, তাকে কার্যত বর্জন করে।
এ পার্টি এমনকি ৩য় আন্তর্জাতিকের ৬ষ্ঠ কংগ্রেসের লাইন
অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত ভারতবর্ষে কৃষক সমস্যাকে আঁকড়ে ধরা, গণতান্ত্রিক
বিপ্লবের সমস্যাকে আঁকড়ে ধরা এবং বড় ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের
বিপ্লবের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার কাজও করতে পারেনি। তারা একটি
শ্রমিকবাদী লাইন অনুসরণ করে গেছে, যা কার্যত শ্রমিক শ্রেণির ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাঝে
নিজেদেরকে আটকে ফেলে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ও সমাজ রূপান্তরের বিপ্লবী আন্দোলন, তথা ভারতবর্ষের
বিশালায়তন কৃষকের সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের কেন্দ্রীয়
সমস্যাকে উপলব্ধি করতেই ব্যর্থ হয়। তারা একদিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক
বিপ্লবকে একাকার করে ফেলেছে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক স্তরে বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্যের নামে
বড় বুর্জোয়াদের (মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের)
লেজুড়বৃত্তির লাইন অনুসরণ করে গেছে।
২য় বিশ্বযুদ্ধকালে এ পার্টি ফ্যাসিবাদবিরোধিতার নামে বৃটিশ
সাম্রাজ্যবাদ ও কংগ্রেসী মুৎসুদ্দি রাজনীতির
সেবা করে। ৩য় আন্তর্জাতিকের অপর এক প্রধান পার্টির নেতৃত্বে
৩০ ও ৪০-দশকের চীন বিপ্লবের অগ্রগতি থেকে শিক্ষা নিতে এই পার্টি সম্পূর্ণ ব্যর্থ
হয়। এভাবে এ পার্টি এ ধরনের দেশে নয়াগণতন্ত্র, কৃষি বিপ্লব ও গণযুদ্ধের রাজনীতি আবিষ্কার করতে-যে
ব্যর্থ হয় শুধু তা-ই নয়, বহু পরিমাণে
সংশোধনবাদী উপাদানে সে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলে। যার চূড়ান্ত বিকাশ
ঘটে আন্তর্জাতিক পরিসরে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত রাশিয়ায় ক্রশ্চভীয়
সংশোধনবাদ আসামাত্র এ পার্টি তার এক প্রধানতম লেজুড় ও সমর্থনকারী শক্তিতে পরিণত হয়। যাকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায়
নেতৃত্ব দিয়েছিল মনিসিং-মোজাফ্ফর-মতিয়া চক্র।
কিন্তু এ সব সত্ত্বেও আদি কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিবাচক
অবদানগুলোকে এক কথায় বাতিল করে দিলে চলবে না। এই পার্টিই
ভারতবর্ষের মত পশ্চাদপদ কৃষি-প্রধান বিশাল এক দেশে কমিউনিজমের মতবাদকে নিয়ে এসেছিল। শুধু তাই নয়, তাকে রাজনীতির এক
নতুন ধারায় প্রতিষ্ঠা করেছিল। মার্কসবাদকে, মহান লেনিন ও স্ট্যালিনকে, রুশ বিপ্লবকে, ফ্যাসিবিরোধী
কমিউনিজমের মহান সংগ্রামকে,
শ্রমিক-কৃষকের স্বতন্ত্র রাজনীতি-মতবাদ-ক্ষমতা-রাষ্ট্র ও বিপ্লবের বাণীকে
উপমহাদেশে তা অতি অল্প সময়ে বিপুল জনপ্রিয় করতে পেরেছিল। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত
শ্রেণি থেকে এক বিপুল পরিমাণ বিদ্রোহী, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী তরুণকে এ পার্টি মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক
বিপ্লবী মতবাদের বলয়ে টেনে এনেছিল। এবং তেলেঙ্গানা (ও এদেশে তেভাগা-র মহান
সংগ্রামসহ বহু ধরনের শ্রমিক, শ্রমজীবীদের আন্দোলন ও একটি শক্তিশালী প্রগতিশীল আন্দোলন
সৃষ্টি করতে পেরেছিল। এইসব ঐতিহ্য তার রাজনৈতিক দুর্বলতাসহ আমাদেরই
ঐতিহ্য, যা আমরা অন্য কাউকে
দিয়ে দিতে পারি না, তার উপর
সংশোধনবাদীদেরকে ভাগ বসাতে দিতেও পারি না। কিন্তু একইসাথে তার
সাথে বিপ্লবী রাপচার না ঘটিয়ে আমরা এক পা এগুতেও পারি না।
নব্য মাওবাদী আন্দোলন এইভাবে না এগোনোর ফলে তার দ্বারা
ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদের সাথে বাস্তবে একাকার করা আদি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সরল
বর্জন যতটা হয়েছে, ততটাই হয়নি তার সাথে
লাইনগত সংগ্রাম গভীর করার মধ্য দিয়ে তার সাথে বিপ্লবী রাপচার। ফলে পরবর্তীকালে
মাওবাদী আন্দোলনে আদি কমিউনিস্ট আন্দোলনের অর্থনীতিবাদ-সংস্কারবাদ এবং
জাতীয়তাবাদের বিরাট প্রভাব থেকে যায় যা অন্যান্য রূপে নিজেকে প্রকাশ করে- যে সম্বন্ধে আমরা
পরে আলোচনা করবো।
* আদি পার্টির যে
গুরুতর বিচ্যুতিগুলোর কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তার অন্তত কিছু অংশ- যেমন, ফ্যাসিবিরোধী
সংগ্রামের নামে বৃটিশের লেজুড়বৃত্তি, তৎকালীন অগ্রসরমান
চীনা বিপ্লব থেকে না শেখা,
কৃষিবিপ্লবকে আঁকড়ে না ধরা ও দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধকে রণনীতি হিসেবে গ্রহণ না
করা- প্রভৃতি ক্ষেত্রে
স্ট্যালিন ও তাঁর নেতৃত্বে ৩য় আন্তর্জাতিকের বিরাট ভূমিকা ছিল- সেকথা ভুলে গেলে
চলবে না। সুতরাং ভারতীয় ও পূর্ব পাকিস্তানী আদি
কমিউনিস্ট পার্টির মৌলিক ভুলের পেছনে স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট
আন্তর্জাতিকের ভূমিকার সারসংকলন ব্যতীত এই টুএলএস গভীর ও পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। মাও সম্পূর্ণত না
হলেও মৌলিকভাবে জিপিসিআর প্রস্তুতিকালে- ৬০-দশকের প্রথমার্ধেই স্ট্যালিনের সাথে এই রাপচার
ঘটান। এই অভিজ্ঞতা আমাদের মাওবাদী আন্দোলনে আদৌ পৌঁছেনি বললেই চলে। বরং বহু ক্ষেত্রে
মাওবাদী আন্দোলন স্ট্যালিনকেই অনুসরণ করে, যদিও তারা তত্ত্বগতক্ষেত্রে মাওচিন্তাধারার কথা
বলেছে। এভাবে কার্যত মাওবাদের দুর্বল ও অসম্পূর্ণ উপলব্ধি থেকেই মাওবাদী আন্দোলন
এদেশে যাত্রা শুরু করেছিল। যা সূচনাতেই তার বহুধা বিভক্তির অন্যতম কারণও বটে, যদিও তার নিজস্ব
অন্যান্য কারণও রয়েছে।
গ) টুএলএস-এর মধ্য দিয়ে লাইন বিনির্মাণ ও পার্টি-গঠনকে উপলব্ধি না করা ও
প্রয়োগ করতে না পারাঃ
ক্রুশ্চভীয়-মনিসিং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও
সংগ্রামের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একটি সঠিক সর্বহারা বিপ্লবী লাইন বিনির্মাণ, তার ভিত্তিতে একটি
প্রকৃত বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন এবং সে পার্টির নেতৃত্বে একটি সফল বিপ্লবী
সংগ্রাম গড়ে তোলা।
ষাট-দশকের শেষার্ধে বিশ্বব্যাপী টালমাটাল বিপ্লবী
পরিস্থিতিতে মাও যখন সংশোধনবাদের সাথে পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ কার্যকর করার জন্য আহ্বান
জানালেন “হেডকোয়ার্টারে তোপ
দাগাও”- তখন সেই মহান আহ্বান
এদেশেও প্রকৃত বিপ্লবীদের অন্তরে এসে আছড়ে পড়ে বিদ্রোহের ঢেউ জাগিয়ে তুললো। তারা সংশোধনবাদের
বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারা ন্যায্যভাবেই সংশোধনবাদী ইপিসিপি থেকে
পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটালেন। কিন্তু এই বিচ্ছেদ সাংগঠনিকভাবে যতটা সম্পূর্ণ ছিল, মতাদর্শগত-রাজনৈতিক
লাইনের পরিসরে ততটা সম্পূর্ণ বা গভীর হতে পারেনি।
এর অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল বিপ্লবীদের ভুল বা সংশোধনবাদী
উপাদান, এবং পূর্ণাঙ্গ কোন
সংশোধনবাদের মধ্যকার পার্থক্যকরণ এবং সেসবের সাথে সংগ্রামের পদ্ধতিশাস্ত্রগত (Methodology) সমস্যা। শুরু থেকেই এই
সংগ্রামে একতরফাবাদ, বিভেদপন্থা ও
সংকীর্ণতাবাদের ত্রুটি থেকে গেল। আন্তরিক বিপ্লবীদের নিজেদের মধ্যকার সংগ্রামকেও
সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রাম বলে বৈরীভাবে গড়ে তোলা হলো। বৃক্ষকে অরণ্য বলা
হলো। টুএলএস-এর মধ্য দিয়ে লাইন-বিনির্মাণ ও পার্টি-গঠনকে আঁকড়ে না ধরে আত্মগতভাবে
একেকটা আংশিক, খন্ডিত লাইন নিজেকে সম্পূর্ণ সঠিক বলে দাবি করলো এবং বিরোধী অন্য
সমস্ত লাইনকে সংশোধনবাদী আখ্যা দিল। এটা একদিকে যেমন একটি নবউদ্ভূত বিপ্লবী লাইন
বিনির্মাণকে পঙ্গু করে দিল,
অন্যদিকে এটা প্রকৃত সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামকেও দুর্বল করে দিল। নিজেদের মধ্যকার
সংগ্রাম, আর সংশোধনবাদবিরোধী
সংগ্রাম একাকার হয়ে গেল।
এর ফলশ্রুতিতে অতিদ্রুত মাওবাদী আন্দোলনের সূচনাতেই
অনেকগুলো কেন্দ্র এদেশে গড়ে উঠলো। যা মাওবাদী আন্দোলনের অভ্যন্তরস্থ লাইন-সংগ্রামে
সকল পক্ষকে গুরুতর সংকীর্ণতা, অগভীরতা, আত্মগতভাব, একতরফাবাদ ও বিভেদপন্থায় চালিত করলো। যা পরবর্তীকালে
মাওবাদী আন্দোলনের সকল পর্যায়ে তাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।
* আদর্শগত সংগ্রামের
দীর্ঘসূত্রতা, উত্তরণকালের
স্বাভাবিক দ্বৈততা, এবং সামগ্রিকতা ও
অংশের দ্বন্দ্ব ও ঐক্যকে মাওবাদী আন্দোলন উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। এ সময়ে ও তার
প্রক্রিয়ায় পরবর্তী ৩/৪ বছরের মধ্যে আঃ হক নেতৃত্বাধীন ইপিসিপি/এমএল, মতিন-আলাউদ্দিন
নেতৃত্বাধীন পূবাকপা/মালে,
এসএস নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি, এবং তোহা-সুখেন্দু নেতৃত্বাধীন বিএসডি/এমএল- এই চারটি প্রধান ধারায়
মাওবাদী আন্দোলন বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও আরো বেশ কিছু সংগঠন ও কেন্দ্র এ সময়ে গড়ে
ওঠে যারা উপরোক্ত ৪টি ধারার মত দৃঢ়ভাবে মাওবাদকে গ্রহণ না করলেও নিজেদেরকে
মাওচিন্তানুসারী বলে প্রকাশ করে। এই সবগুলো ধারা, উপধারা, কেন্দ্র, সংগঠন- টুএলএস-কে গভীর করতে কম/বেশি ব্যর্থ হয়, প্রধানত এই কারণে যে, প্রায় প্রথম থেকেই
সবগুলো কেন্দ্র শুধু নিজেদেরকেই সঠিক মাওবাদী দাবি ক’রে অন্যদেরকে
সংশোধনবাদী বলে চিহ্নিত করে দেয়।
সংশোধনবাদ একটি সামগ্রিক চরিত্র ধারণ করলে পরেই তার সাথে
মার্কসবাদের সম্পর্ক সামগ্রিক বিচ্ছেদ ও বিভেদের হতে পারে। নতুবা সংশোধনবাদ
বিভিন্ন রূপে ও মাত্রায় পার্টিতে সর্বদাই থাকে। তাই বলে পার্টি
সর্বদাই সংশোধনবাদী হয়ে থাকে না, বা ভিন্নমতগুলোর ত্রুটি সত্ত্বেও ভিন্নমতধারীদের সার্বিক
চরিত্র সংশোধনবাদী হয় না। পার্থক্য মাত্রই সংশোধনবাদ-মার্কসবাদ দ্বন্দ্ব, এবং সংশোধনবাদ মানেই
তার সাথে বিভেদের সংগ্রাম পরিচালনা- এই অনুসৃত ধারাটির মৌলিক সমস্যা হলো বস্তুর
সামগ্রিক চরিত্র আর আংশিক দিককে একাকার করে ফেলা। মাও যাকে বলেছেন, বৃক্ষকে অরণ্য বলা। বাস্তবে পার্টিতে
এইসব মতপার্থক্যের মধ্যকার সংগ্রামই পার্টির অভ্যন্তরীণ চালিকা শক্তি রূপে কাজ করে। এটা আমরা মাওবাদ
থেকে শিখেছি। কিন্তু স্ট্যালিনীয় ধারায় পার্টিকে একস্তম্ভী মনে
করার ভুল দার্শনিক ও দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা একে বুঝতে ও সঠিকভাবে মীমাংসা করতে
ব্যর্থ হয়। আমাদের দেশে শুরু থেকেই মাওবাদী আন্দোলন কার্যত এই
স্ট্যালিনীয় ভুলকে অনুসরণ করেছে ও মাওবাদ আত্মস্থ করতে ও প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এভাবে মাওবাদী
শিবিরের অভ্যন্তরে একটি বৈরী বিভেদাত্মক সংগ্রাম পরিচালনার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, যাকে কিনা
সংশোধনবাদবিরোধী মহান সংগ্রাম বলেও গর্ব করা হয়েছে, এবং এটা মাওবাদী আন্দোলনে লাইন বিনির্মাণ ও পার্টি
গঠনে বিশাল ক্ষতি সাধন করেছে।
এমনকি সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামেরও একটি প্রক্রিয়া রয়েছে- যা টুএলএস-কে বিকশিত
করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। সামগ্রিক বিচ্ছেদ ও ন্যায্য বিভেদ এ
লাইন-সংগ্রামেরই ফলশ্রুতি মাত্র। সঠিক ও সুগভীর টুএলএস-ই সংশোধনবাদকে পরিপূর্ণভাবে
উন্মোচন করে, সঠিক লাইনকে বিকশিত
করে এবং আন্তরিক কর্মী-জনগণ, এমনকি নেতৃত্ব পর্যায়েও ইতিবাচক রূপান্তর ঘটায়।
বিপ্লবী পার্টিতে ও আন্দোলনে সর্বদাই মতপার্থক্য থাকে, তা টুএলএস-এ পরিণত
হতে পারে। এই টুএলএস আংশিক, খন্ডিত, এমনকি সামগ্রিক
চরিত্র বিশিষ্ট কিন্তু এখনো সামগ্রিক নয় এমন হতে পারে। আন্দোলন অভ্যন্তরস্থ
সংগ্রাম সবই এক চরিত্রের নয়। বরং ব্যাপকভাবে তা তার অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, যাকে আমরা তার
অন্তঃসংগ্রাম বলে চিহ্নিত করতে পারি। সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামের থেকে এই অন্তঃসংগ্রামের
চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। এটা হলো সামগ্রিকতা ও অংশের পার্থক্য, শ্রেণি চরিত্রের
পার্থক্য, বিপ্লব বর্জন ও
বিপ্লবী থাকার পার্থক্য।
কিন্তু অন্তঃসংগ্রামেও ভুলটা ভুলই, সেটা সঠিক নয়। এবং ভুল মত/পলিসি/
কৌশল/লাইন সর্বহারা শ্রেণিকে সেবা করে না। ফলত তা অসর্বহারা
চরিত্র ধারণ করে। কিন্তু কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক সেটা প্রায়ই দীর্ঘ
সামাজিক অনুশীলন এবং ধৈর্যশীল, নমনীয় ও সুগভীর তত্ত্বগত বিতর্ক ছাড়া নির্ধারণ করা কঠিন, প্রায়শ অসম্ভব। টুএলএস-এর
তত্ত্বুগত/লাইনগত সংগ্রাম,
এবং অনুশীলন- এই দু’য়ের মধ্য দিয়ে
সঠিক/বেঠিক বেরিয়ে আসে। সুতরাং এধরনের সংগ্রামকে সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রামের
সাথে গুলিয়ে ফেলাটা ভয়ংকর। যা কিনা সূচনাতেই মাওবাদী আন্দোলনকে গ্রাস করে। এভাবে লাইন
বিনির্মাণ ও পার্টিগঠন দুটোই শুরু থেকেই সঠিক দিশা হারিয়ে ফেলে।
এর ফলে প্রকৃত সংশোধনবাদবিরোধী সংগ্রাম, যার কেন্দ্র তখন ছিল
মনি-মোজাফ্ফর চক্রবিরোধী সংগ্রাম, সেটাই গুরুতরভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এবং লাইন-বিনির্মাণকে
গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
ঘ) মতাদর্শগত সংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে গুলিয়ে ফেলা:
উপরে আলোচিত অন্তঃমাওবাদী সংগ্রামে বিভেদ শুধু এ জায়গাতেই
সীমাবদ্ধ থাকলো না। সংশোধনবাদবিরোধী আদর্শগত/মতাদর্শগত সংগ্রাম আর
রাজনৈতিক সংগ্রামকে কার্যত গুলিয়ে ফেলা হয়।
“সংশোধনবাদী মানেই
প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী বা
শত্রু”- এই ধরনের সূত্র
মাওবাদী আন্দোলনে রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়। এর ফলশ্রুতিতে যে
মাওবাদী কেন্দ্রগুলো একে অন্যকে সংশোধনবাদী বলে চিহ্নিত করলো, তারা কার্যত
পরস্পরকে প্রতিক্রিয়াশীল,
প্রতিবিপ্লবী হিসেবেও মূল্যায়ন করে বসলো। স্বভাবতই যারা মূলত
মাওবাদী নয়, কিন্তু মাওকে তুলে
ধরতো, এমনকি
মাওচিন্তাধারার বিভিন্ন অমাওবাদী ব্যাখ্যা দিত, অথবা নিজেদেরকে মার্কসবাদী দাবি করতো এমনসব ক্ষুদে
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংগঠন-কেন্দ্রকেও প্রতিক্রিয়াশীল বলে মূল্যায়ন করলো। এভাবে দ্বন্দ্বের
দুই প্রকৃতিকে গুলিয়ে ফেলার গুরুতর ভুল করা হয়। যা যুক্তফ্রন্ট
গঠনের কাজকেও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। যদিও ’৭৪-সাল পর্যন্ত
বিস্তৃত মাওবাদী আন্দোলনের এই ১ম পর্বের সময়কালে আমাদের পার্টিসহ বিভিন্ন কেন্দ্র
বিভিন্ন সময়ে খন্ড খন্ড ভাবে দ্বন্দ্বের প্রকৃতিকে এভাবে গুলিয়ে ফেলার গুরুতর ভুল
পথ থেকে বেরুবার প্রয়াশ পেয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে উপরোক্ত ভুল লাইন থেকে কখনোই বিচ্ছেদ
ঘটেনি। তত্ত্বগত পরিসরে অস্পষ্টতা থেকে বের হতে না পারার কারণে অন্তত তত্ত্বগতভাবে ‘প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিবিপ্লবী’ লেবেল করার
মতাদর্শগত-রাজনৈতিক ধারা থেকে এ সময়কার মাওবাদী আন্দোলন বেরুতে ব্যর্থ হয়।
* একটি সংগঠন/কেন্দ্র
নিজেকে মতবাদিকভাবে কোন ধারার অনুসারী বলে দাবি করছে সেটা তার সাথে আমাদের
সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও তার সাথে রাজনৈতিক সংগ্রামের ও সম্পর্কের
জন্য মূল বিষয় এটা নয়। এটা নির্ধারিত হয় তার প্রকৃত শ্রেণি চরিত্র ও
প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি দ্বারা।
আজকের যুগে যখন নিপীড়িত শ্রেণি/জাতির কাছে পুঁজিবাদের মতবাদ
তার গুরুত্ব হারিয়েছে তখন এইসব জনগোষ্ঠী নিজেদের মুক্তি আন্দোলনে বেশি বেশি করে
মতবাদিকভাবে মার্কসবাদের দ্বারস্থ হয়। বিশেষত গত শতকে ষাট/সত্তর দশকের বিশ্বব্যাপী
গণউত্থানের সময়কালে সারা বিশ্বজুড়েই সংগ্রামরত বহুবিধ শ্রেণি/গোষ্ঠী নিজেদেরকে
মার্কসবাদী, এমনকি মাওবাদী দাবি
করতে থাকে। এটা কোন খারাপ বিষয় নয়, বরং কমিউনিস্ট
আদর্শেরই এক জগতজোড়া ইতিবাচক অগ্রগতির ফল। এটা এখনো বিশ্বের সব
জায়গাতেই দেখা যাবে। যা বিশ্ব বিপ্লবের অগ্রগতি ও গণসংগ্রামের জোয়ারের
সময়ে আরো বেড়ে যাবে।
স্বাভাবিকভাবে একটি সংগঠন/কেন্দ্র নিজেকে কমিউনিস্ট/মাওবাদী
দাবি করলেই সে মাওবাদী হয়ে যাবে- এটা কেউ আশা করবে না। বিপুল পরিমাণে সংগঠন
সর্বহারা শ্রেণির মতবাদকে গ্রহণ করা বা আত্মস্থ করা, এবং বিশেষভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে মাওবাদ থেকে
দূরেই থেকে যায়। তারা বিপ্লবী সর্বহারা পার্টি হবার বদলে বিপ্লবী
জাতীয়তাবাদী, বা বিপ্লবী
গণতন্ত্রী, অথবা সংস্কারবাদী
ধরনের গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবেই থেকে যায়- যারা কিনা মার্কসবাদ/মাওবাদের প্রভাবে প্রভাবিত এবং
তার অনেক উপাদান নিজেদের মতাদর্শ ও রাজনীতিতে মিশিয়ে দেয়। তবে এটাও সত্য যে, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ
ও প্রতিক্রিয়াশীলরা তাদের নিজেদের চক্রান্তের অংশ হিসেবে এ জাতীয় কিছু সংগঠন খুলে
দিতে পারে। কিন্তু সেটা সামগ্রিকভাবে সুপ্রমাণিত না হওয়া
পর্যন্ত একটা পার্টিকে আমরা তার ঘোষিত ও অনুশীলিত রাজনৈতিক কর্মসূচি দ্বারা
মূল্যায়ন করতে এবং তার ভিত্তিতেই আমরা তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য। কোন রকম আত্মগত
মূল্যায়ন দ্বারা চালিত হয়ে এই সম্পর্কের নীতি নির্ধারণ করলে তা আমাদের রাজনৈতিক লাইনে
বড় সমস্যা আকারে উপস্থিত হবে। এ ধরনের সংগঠন তাদের নিজস্ব
গণতান্ত্রিক/প্রগতিশীল/এমনকি মধ্যবিত্ত বিপ্লবী লাইন দ্বারা বিপুল সংখ্যক সংগ্রামী
জনগণকে নিজেদের পিছনে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে- যারা সর্বহারা পার্টির মিত্র হিসেবে- আংশিক বা সামগ্রিক, সাময়িক বা কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী- কাজ করতে পারে।
এই ধরনের সংগঠন নিজেদেরকে মার্কসবাদী দাবি করায়, এমনকি অনেকে মাওবাদী
পার্টি দাবি করায় তারা যদি মূলত ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনকে
উপস্থাপন করে, তাহলে তারা
সারবস্তুগতভাবে সংশোধনবাদকেই নিয়ে আসতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে তাদের এই
সংশোধনবাদের সাথে একটা দীর্ঘস্থায়ী মতাদর্শগত/তাত্ত্বিক সংগ্রামের প্রয়োজন অবশ্যই
থাকবে, থাকবে রাজনৈতিক
সংগ্রামও, কারণ, সংশোধন-বাদের প্রভাব
তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকেও প্রভাবিত করতে বাধ্য, কম বা বেশি করে। কিন্তু এ সংগ্রাম সব
মিলিয়ে জনগণের মধ্যকার সংগ্রাম, এ দ্বন্দ্বকে অবৈরী দ্বন্দ্ব হিসেবেই দেখতে হবে।
সংশোধনবাদ হলো মার্কসবাদবিরোধী মতবাদ। তাই, তা প্রতিক্রিয়াশীল
মতবাদ, অসর্বহারা মতবাদ। এ কারণে সর্বহারা
মতবাদ/মতাদর্শ তার সাথে মিলমিশ করে নিতে পারে না। মার্কসবাদকে আদর্শগত
ও তত্ত্বগতক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী একরোখা সংগ্রাম সংশোধনবাদের সকল রূপের বিরুদ্ধে
অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তার সাথে রাজনৈতিক
সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবীরূপে সর্বদাই বৈরী। এটা নির্ভর করে প্রতিটি সংগঠনের নির্দিষ্ট সময়ের
নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচির উপর। অবশ্যই মতবাদিক প্রশ্ন ও রাজনৈতিক প্রশ্ন বিচ্ছিন্ন
নয়। কিন্তু সম্পর্কটা সরলরৈখিকও নয়। যাকিনা মাওবাদী আন্দোলন মূলত মনে করেছে।
- ষাট-সত্তর দশকে সংশোধনবাদের প্রধানতম কেন্দ্র
সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হবার কারণে রুশ
সংশোধনবাদবিরোধী মতাদর্শগত সংগ্রাম সেসময়ে একইসাথে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে মিলে গিয়েছিল। তাই, শুধু সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্যই নয়, আমাদের মত
সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশে রুশ সংশোধনবাদ বিপ্লবের শত্রুর ভূমিকায় আবির্ভূত
হয়েছিল। কিন্তু একারণে মতবাদিক সংগ্রামের সাথে রাজনৈতিক সংগ্রামকে একাকার করে ফেলা যায়
না।
যেমন, ৭০-দশকের পরে হোক্সাপন্থা কট্টর মাওবাদবিরোধী হিসেবে
আবির্ভূত হয়েছে। কট্টর মাওবাদবিরোধিতা তাদের রাজনৈতিক লাইন ও
কর্মসূচিকেও প্রভাবিত করতে বাধ্য। কিন্তু এটা অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদেরকে সর্বত্র ও
সর্বদা বিপ্লবের শত্রু কাতারে ফেলে দেয় না। তা নির্ভর করে
সবকিছু মিলিয়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তি নির্দিষ্ট সময়ে কী রাজনৈতিক কর্মসূচি ধারণ
ও প্রয়োগ করছে তার উপর।
আমাদের মত পশ্চাদপদ দেশ, যেখানে বিপ্লবের স্তর নয়া গণতান্ত্রিক, সেখানে এই প্রশ্নের
গুরুত্ব খুবই বেশি। কারণ, এখানে বহু বিভিন্ন বুর্জোয়া মতবাদিক রাজনীতির সাথে
সর্বহারা পার্টিকে যুক্তফ্রন্টের কাজ করতে হবে। কিন্তু এর গুরুত্ব
যে শুধু বিপ্লবের এই স্তরের জন্য তা নয়। সমাজতান্ত্রিক
রাষ্ট্রেও এর গুরুত্ব থাকবে। বহু মতবাদিক সংগ্রামকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে পরিচালনা
করতে হবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেও। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে
যুক্তফ্রন্ট, অবৈরী সম্পর্ক, সমঝোতা ইত্যাদি সেখানে
থাকতে হবে। কেউ যদি সারমর্মে মাওবাদী না হয়, সারমর্মে
সমাজতন্ত্রী না হয়, কিন্তু নিজেকে দাবি
করে মাওবাদী বা সমাজতন্ত্রী, তাহলে তার ঘাড় ধরে আমরা দাবি করতে পারি না যে সে নিজেকে
মাওবাদী দাবি পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা তার সাথে কোন অবৈরী বা সমঝোতামূলক
সম্পর্কে যাবো না। তেমনি কেউ যদি আদর্শগতভাবে মাওবাদকে ভুল মনে করে, তার বিরোধিতা করে, তাহলেও আমরা তার সে
অবস্থান পরিত্যাগ না করলে তার সাথে কোন সম্পর্কে যাবো না বলে পণ করতে পারি না। রাজনৈতিক শক্তির
সাথে, সে যে-ই হোক, সম্পর্ক সর্বদাই
নির্ধারণ করতে হবে সবমিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে তার রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে, তার শ্রেণি চরিত্রের
ভিত্তিতে। কেউ নিজেকে যা-ই দাবি করুক না কেন, যদি বিপ্লবের
শত্রুদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের সাথে তার সম্পর্কযুক্ত থাকার অকাট্য প্রমাণ আমাদের
না থাকে, তাহলে আমরা তার
শ্রেণি চরিত্র ও রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে তাকে মূল্যায়ন করবো এবং সম্পর্ক
নির্ধারণ করবো। কিন্তু আমরা মতাদর্শগত সংগ্রাম ও রাজনৈতিক
সংগ্রামকে একাকার করে ফেলে তখন গুরুতর ভুল করেছি যার ফল বিপ্লবের গুরুতর ক্ষতি
ডেকে এনেছে এবং বুর্জোয়া প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির বিরাট উপকার করেছে।
- উপরোক্ত ভুলের কারণে
ষাট-সত্তর দশকে মাওবাদীরা অন্য বহু সংখ্যক মাওবাদী বা কমিউনিস্ট দাবিদার মধ্যবিত্ত
শ্রেণিচরিত্রসম্পন্ন, কিন্তু বাম
প্রগতিশীল দলের সাথে সম্পর্ক কার্যত বৈরী করে ফেলে। শুধু তাই নয়, ভিন্ন-ধারার প্রকৃত
মাওবাদীদেরকেও সংশোধনবাদী বলে চিহ্নিত করার ফলে তাদেরকেও প্রায় শত্রুর কাতারে ফেলে
দিয়েছে। এটা একটা বড় মৌলিক কারণ যে, কেন ’৭১-সালের মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী
বহু বামপন্থী ও মাওপন্থী সংগঠন ও শক্তি খন্ড খন্ড ভাবে যে সংগ্রাম করেছিল তা পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে ও
আওয়ামী-ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে একটা জোটে আসতে
ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও নিজেদের মাঝে সংকীর্ণতাবাদী বৈরী
সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বারও উপক্রম হয়। ’৭৪-পর্যন্ত যে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম ও গণআন্দোলন
সারা দেশকে প্লাবিত করেছিল,
তার প্রধানাংশ মাওবাদী ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে থাকা সত্ত্বেও
কেন তা একটা জোটবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি। তা যদি হোত, তাহলে ’৭১-সালে বা তার পরে
এদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। এমনকি তা বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে
আসার প্রক্রিয়ায় তাদের মধ্যকার লাইনগত সংগ্রামকেও গভীর করার শর্ত সৃষ্টি করতে
পারতো এবং একটি সঠিক লাইন বিনির্মাণ এবং একটি একক ও ঐক্যবদ্ধ পার্টি গঠনে তা
ভুমিকা রাখতে পারতো। দুঃখজনকভাবে এই পর্বে-তো সেটা হয়ইনি, পরবর্তীকালে এর জের
মাওবাদী আন্দোলন বিগত শতক জুড়েই বহন করেছে- কম বা বেশি করে- যা এমনকি এখনো তার কুপ্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে
পারেনি।
* উপরোক্ত সমস্যাবলীর
কারণে মাওবাদী আন্দোলনের সূচনাতেই একটা সামগ্রিক সঠিক লাইন বিনির্মাণের সঠিক
প্রক্রিয়া থেকে এই আন্দোলন বিচ্যুত হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষুদ্র ও
ক্ষণিকস্থায়ী সংগঠন ছাড়াও এ আন্দোলন ’৭১-সালের মধ্যে প্রধান যে চারটি ধারায় বিভক্ত হয়ে
পড়েছিল সেগুলোর থেকে বিভিন্ন সময়ে ছোট/বড় বিভিন্ন অংশ ছিটকে আন্দোলন থেকে বেরিয়ে
গেলেও এই চারটি ধারা মূলত ’৭৪-সাল পর্যন্ত এই
প্রথম পর্বের সার্বিক বিপর্যয় দৃশ্যমান না হওয়া অবধি মাওবাদী বিপ্লবী শিবিরের
মধ্যে সক্রিয় থাকে।
এই চারটি ধারা এদেশে সর্বহারা শ্রেণির মতবাদ হিসেবে
মাওবাদকে প্রতিষ্ঠা করায় বিভিন্নমুখী ও মাত্রার ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তারা
ক্রুশ্চভ-ব্রেজনেভ সংশোধনবাদ ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসিকে সংগ্রাম করে, জিপিসিআর-কে তুলে
ধরে, নয়াগণতন্ত্রকে তুলে
ধরে, সংসদীয় ধারার মুখোশ
উন্মোচন করে, এবং সশস্ত্র বিপ্লবী
সংগ্রাম পরিচালনা করে। এভাবে তারা বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের
প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ও ধারার বিপরীতে এক বিপ্লবী গণমুখী রাজনীতির ধারাকে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, এজন্য বিপুল ত্যাগ ও অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করে, অসংখ্য নেতৃত্ব ও
কর্মী-জনগণ এর জন্য অতুলনীয় বিপ্লবী দৃঢ়তায় জীবন বিসর্জন দেন এবং গণবিপ্লবী
সংগ্রামের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেন।
কিন্তু উপরেই আলোচিত হয়েছে যে, এই মাওবাদী ও
বিপ্লবী কাঠামোর মধ্যে এই সময়কার আন্দোলন ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও সমগ্র আন্দোলনেই
রাজনৈতিক লাইনে বিভিন্ন বিচ্যুতি কাজ করেছে যা একদিকে মাওবাদী আন্দোলনকে বিভক্ত
রেখেছে, অন্যদিকে বিপ্লবী
সংগ্রামকে আরো এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করেছে। এবং একটি ঐক্যবদ্ধ
একক শক্তিশালী মাওবাদী পার্টি গঠনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। আমরা এখন মৌলিক
রাজনৈতিক প্রশ্নাবলীতে আন্দোলনের এই প্রথম পর্বের ত্রুটিগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা
করবো।
“রাজনৈতিক সমস্যাবলী’’
১। আর্থ-সামাজিক
ব্যবস্থা
মাওবাদী আন্দোলন সমগ্রভাবে তার সূচনাতেই আমাদের দেশকে
সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিপীড়িত একটি কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে সঠিকভাবেই মূল্যায়ন
করেছে, যেখানে
সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কগুলো ব্যাপকভাবে বিরাজমান। একইসাথে আমলা-মুৎসুদ্দি শ্রেণি
যেখানে বিকাশ লাভ করেছে। এই ধরনের সমাজকে সাধারণভাবে আধা/নয়া ঔপনিবেশিক
রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বলে চিহ্নিত করাটাও সে সময়ে সঠিক
ছিল। সেকারণে সঠিকভাবেই মাওবাদী আন্দোলন বিপ্লবের স্তরকে নয়াগণতান্ত্রিক বলে
নির্ধারণ করতে পেরেছিল। এবং শ্রেণি বিশ্লেষণ ও
শত্রু-মিত্র নির্ধারণ রণনৈতিকভাবে মূলগতভাবে সঠিক ছিল।
কিন্তু সমাজ-বিশ্লেষণে অনেকগুলো গুরুতর সমস্যা তখন থেকেই
মাওবাদী আন্দোলনে গড়ে উঠেছিল, যা মাওবাদী আন্দোলনকে বিভক্ত করতে ও বিভক্ত রাখতে শুধু শর্ত
জুগিয়েছে তা নয়, বরং পরবর্তী
সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে তার কোন ইতিবাচক মীমাংসাও হয়নি। বিষয়গুলো নিচে
আলোচনা করা হচ্ছে।
ক) একদিকে জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি, অন্যদিকে জাতীয়
সমস্যার বিশেষত্বকে না বোঝা ও গণ-আকাংখাকে ধরতে না পারাঃ
* মাওবাদী আন্দোলন
শুরু থেকেই সমাজ-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ও রূপের জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি
দ্বারা পরিচালিত হয়।
মাওবাদী আন্দোলনের সূচনাকালে পূর্ব বাংলা (বর্তমানের
বাংলাদেশ) তৎকালীন অখন্ড পাকিস্তানের অংশ ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক
কারণে এবং পাকিস্তানের দুই অংশের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার বাস্তব কারণে শুধু পূর্ব
বাংলাকে কেন্দ্র করে মাওবাদী আন্দোলন বিকশিত হয়। এটা একটা বাস্তব
কারণ ছিল বটে, কিন্তু একটি
আন্তর্জাতিকতাবাদী পার্টি হিসেবে শুরু থেকেই সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্র ভিত্তিক
কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার নীতি ও বাস্তব পদক্ষেপসমূহ না নিয়ে শুধু পূর্ব
বাংলাভিত্তিক লাইন হাজির করার মাঝে শুরুতেই জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি কাজ করেছিল। পূর্ব বাংলাভিত্তিক
লাইন হাজির করার ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তানী জাতীয় নিপীড়ন এবং আওয়ামী
লীগের নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পেক্ষাপট গুরুতর
বাস্তব শর্ত সৃষ্টি করেছিল বটে, কিন্তু সেটা সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদকে সঠিকভাবে প্রয়োগ
করতে না পারাকে যুক্তিযুক্ত করে না ।
* মাওবাদী ধারাগুলোর
মাঝে এই প্রথম পর্বে আমাদের পার্টির রাজনৈতিক লাইনে পূর্বাপর জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি
কাজ করেছে। কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে আমাদের পার্টি তার
পৃথক সত্তা গড়ে তোলার একটা প্রধানতম তাত্ত্বিক ভিত্তি পেয়েছিল এই জাতীয়তাবাদী
বিচ্যুতি থেকে। পার্টি পূর্ব বাংলার অতীত সমাজ বিশ্লেষণেও জাতীয়তাবাদী
বিচ্যুতি দ্বারা চালিত হয়। পার্টি মূল্যায়ন করেছিল যে, বৃটিশ শাসিত অবিভক্ত
ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বটি একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব ছিল, এবং এর দ্বারা
পার্টি বিপ্লবী নেতৃত্বের অভাবে ভারতবর্ষের বিভক্তির পক্ষে একটি ন্যায্যতা খুঁজে
পায়। এটা কার্যত তৎকালীন মুসলিম জাতীয়তাবাদের
প্রভাব থেকে সৃষ্ট একটি বিচ্যুতি ছিল, যার উৎস ছিল বস্তুর
সারমর্মকে না দেখে তাকে উপরি উপরি দেখার মধ্যবিত্ত প্রয়োগবাদী সমস্যা।
* দৃষ্টিভঙ্গির এই
সমস্যাই ষাটের দশকের শেষার্ধে মাওবাদী আন্দোলনের সূচনায় পূর্ব বাংলার উপর
পাকিস্তানী জাতীয় নিপীড়নের সমস্যাকে দেখার ক্ষেত্রে কার্যত লেনিনবাদ থেকে সরে যায়। এই অভ্যন্তরীণ জাতীয়
সমস্যাকে পার্টি ঔপনিবেশিক সমস্যা আকারে চিহ্নিত করে, যার সমাধান আকারে
পার্টি পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতার কর্মসূচিকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি আকারে হাজির করে। এটা সাম্রাজ্যবাদের
যুগে ঔপনিবেশিক সমস্যার সাধারণ সমস্যার সাথে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ জাতীয় সমস্যাকে
প্রায় একাকার করে ফেলে এবং এদেশের মাওবাদী আন্দোলনে বড় বিতর্ক ও বিভক্তির জন্ম দেয়।
যদিও ’৭১-সালের ১লা মার্চে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নতুন
ষড়যন্ত্রের মুখে সমগ্র জাতি ও জনগণ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কর্মসূচিতে নতুন এক
সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন, এরই ফলশ্রুতিতে শেখ
মুজিব-আওয়ামী লীগের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব চরম সংকটে পড়ে, এরই এক পর্যায়ে ২৫
মার্চে ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানী বাহিনী পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তির আকাংখা ও
সংগ্রামকে দমনের জন্য সমগ্র জাতি ও জনগণের উপর এক সার্বিক গণহত্যা নামিয়ে আনে, এবং ২৫ মার্চের পর
শেখ মুজিবের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরাও
পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কর্মসূচি আনতে বাধ্য হয়, সেরকম এক বিশেষ অবস্থায় মাওবাদীদের পক্ষ থেকেও নয়াগণতান্ত্রিক
বিপ্লবের অধীনে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতার কর্মসূচি আনাটাই সঠিক ছিল, এবং মাওবাদী
আন্দোলনের অন্য ধারাগুলোও বেশিরভাগ সেটা বিভিন্ন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এনেছিল, কিন্তু কেউই একে
সঠিক মার্কসবাদী-লনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে উত্থাপন করতে পারেনি। যে কারণে
আন্তর্জাতিকতাবাদী সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাখ্যা করতে
না পারায় জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি বিভিন্ন রূপে সমগ্র আন্দোলনে বিরাজমান থাকে। এই মধ্যবিত্ত
জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতিরই একটা নিকৃষ্ট ও বিপরীতধর্মী বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল আঃ হক
নেতৃত্বাধীন ইপিসিপি/এমএল-এর মূল নেতৃত্বের একটি অংশ দ্বারা ভারত-সোভিয়েতের
আগ্রাসনকে বিরোধিতার ন্যায্য অবস্থান থেকে পাকিস্তান রক্ষার প্রতিরোধ যুদ্ধ-লাইন
আনবার ভয়ানক ভ্রান্তির মধ্য দিয়ে। যা কিনা পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় সমস্যাকে
গুরুত্ব সহকারে দেখতে ব্যর্থই শুধু হয়নি, তা থেকে উদ্ভূত জনগণের ন্যায্য আকাংখা ও ন্যায্য
বিদ্রোহের তাৎপর্য বুঝতেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ
হয়েছিল।
* ’৭১-সালের শেষ দিকে
যখন সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মদদে এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের প্রত্যক্ষ
সামরিক সহায়তায় বাঙালী মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা
রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়, এবং একটি স্বতন্ত্র
রাষ্ট্র হিসেবে “বাংলাদেশ” রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, তখন মাওবাদী
আন্দোলনের প্রধানতম অংশই পুনরায় জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব ঘোষণা করার মধ্য
দিয়ে জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতির আরেকটি নবঅধ্যায়ের সূচনা করে। এসবই পরবর্তীকালে
সার্বিক বিপর্যয়সৃষ্ট প্রতিকূল সময়ে একটা প্রধানতম অংশের দ্বারা রুশ-ভারত অক্ষের
বিপরীতে শাসক শ্রেণির মধ্যকার মার্কিনের দালালদের ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করে এবং তার
সাথে যুক্তফ্রন্টের নামে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিতে বিলীন হবার ভিত্তি সৃষ্টি
করেছিল।
* অবশ্য পূবাকপা
ধারাটি উপরোক্ত ধরনের জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান করার রাজনৈতিক লাইন কখনো আনেনি। এমনকি আমাদের পার্টি
ব্যতীত অন্য কোন ধারা ’৭১-পূর্বকালে আমাদের
মত ক’রে ঔপনিবেশিক সমস্যা
বলে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করবার জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতিপূর্ণ রাজনৈতিক লাইনও
আনেনি। কিন্তু অপরাপর ধারাগুলো সবাই একদিকে পূর্ব বাংলাভিত্তিক লাইন পেশের মাধ্যমে
জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতির সমস্যায় একইভাবে আক্রান্ত হয়, অন্যদিকে তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় সমস্যার
বিশেষত্বকে কার্যত গুরুত্বহীন করে বা এড়িয়ে চলে। বড় জোর তার
তাত্ত্বিক স্বীকৃতি দিয়ে তারা বাস্তব কর্মসূচিতে তাকে কার্যত ঊহ্য করে দেয়। এভাবে চীন বা ভারতের
মত একটি আধাঔপনিবেশিক আধাসামন্ততান্ত্রিক সমাজের থেকে পূর্ব বাংলার সমাজের তৎকালীন প্রধানতম
বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে তারা বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং গোঁড়ামিবাদীভাবে অবিকল চীন বা ভারতের
মত করে সমাজের বিশ্লেষণ হাজির করে, যা তাদেরকে ’৭১-সালের জটিল রাজনৈতিক অবস্থায় লেজেগোবরে পরিস্থিতিতে
নিক্ষিপ্ত করে। সমগ্র জাতি যখন পাকিস্তানী ফ্যাসিস্ট আক্রমণকে
প্রতিরোধ করছিল, তখন তাদের একটা অংশ
(যেমন, পূবাকপা ধারা)
সামন্তবাদ প্রধান ক’রে সংগ্রামের লাইন
হাজির করে। কেউ কেউ স্বতঃস্ফুর্তভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা
যুদ্ধ চালায়। কেউবা রুশ-ভারতের আগ্রাসন ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে
পাকিস্তান-রক্ষার প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাবার গণ-আকাংখাবিরোধী লাইনে পরিচালিত হয়। এভাবে সমাজের
গোঁড়ামিবাদী বিশ্লেষণ তাদেরকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।
- একইভাবে তারা ভারতীয়
সম্প্রসারণবাদের বিশেষ চরিত্র বুঝতেও ব্যর্থ হয়। ভারত যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী
দেশ নয়, তাই, তারা দক্ষিণ-এশীয়
অঞ্চলে ভারতের বিশেষ আগ্রাসী সমস্যাকে স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি করে। এবং তাকে
সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের তৎপরতার নিছক নির্দেশ
পালনের মত করে গুরুত্বহীন করে দেয়। অন্যদিকে আমাদের পার্টি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের
ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করে, এবং ’৭১-সালে ও
পরবর্তীকালে তার সম্প্রসারণবাদী ভূমিকাকে কার্যত সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক সমস্যার
সাথে একাকার করে ফেলে।
* এভাবে মাওবাদী
আন্দোলনে সমাজের বিশেষত্বকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি ও সমাজের
বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে না বোঝার থেকে উদ্ভূত যান্ত্রিক ও বাস্তববিচ্ছিন্ন লাইন ও
মূল্যায়ন সার্বিকভাবে সঠিক একটি আর্থ-সামাজিক মূল্যায়ন হাজিরে ব্যর্থ হয়। যা কিনা মাওবাদী
আন্দোলনে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধক হিসেবে, এবং পরবর্তীকালে অনেক রাজনৈতিক অধপতনের ভিত্তি
হিসেবে কাজ করে।
খ) ভূমি সমস্যা ও শ্রেণির রূপান্তর/শ্রেণি বিশ্লেষণঃ
মাওবাদের অনুসরণে কৃষি অর্থনীতিকে আধা সামন্ততান্ত্রিক
মূল্যায়ন করা এবং “খোদ কৃষকের হাতে জমি”- এই নীতির ভিত্তিতে
বিপ্লবী ভূমি-সংস্কারের কথা বললেও পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, বিশেষত কৃষি
অর্থনীতির উপর মূর্ত-নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ ও আলোচনা আনতে মাওবাদী আন্দোলন কার্যত
ব্যর্থ হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে
কৃষি জমির মালিকানার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন
শুরু হয়। এটা একইসাথে গ্রামাঞ্চলের তথা সমগ্র সমাজের শ্রেণি
সজ্জাতেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করে।
এই রূপান্তরকে যথেষ্ট গভীরভাবে আলোচনা দূরের কথা, তার সাধারণ
স্বীকৃতিও মাওবাদী আন্দোলনে পাওয়া যায় না। আমাদের পার্টিতে
কমরেড এসএস আমলের শ্রেণি বিশ্লেষণ দলিলে এমনকি জমিদার শ্রেণির উল্লেখও দেখা যায়
যাকিনা এসেছিল কার্যত চীনা সমাজের শ্রেণি বিশ্লেষণকে প্রায় হুবহু অনুকরণ করার থেকে।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক ও বুর্জোয়া ধারা
থেকে কৃষিতে পুঁজিবাদের বিকাশের উপর বেশ কিছু লাইন ও বিশ্লেষণ হাজির করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোকে
বাস্তব তথ্য-উপাত্ত সহকারে এবং তত্ত্বগত ব্যাখ্যা দ্বারা তেমন একটা খণ্ডন মাওবাদী
আন্দোলন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে মাওবাদী আন্দোলন
যতটা বিতর্ক করেছে রাজনৈতিক লাইন দ্বারা, ততটাই কম আলোচনা করেছে অর্থশাস্ত্রের উপর। এটা মাওবাদী
আন্দোলনের একটি গুরুতর দুর্বলতা ছিল যাকে কখনই সে কাটাতে পারেনি। বরং সেটা কাটাতে
পারার আত্মগত সামর্থ্য মাওবাদী আন্দোলনের দিন দিন কমে এসেছে।
গ) আমলা-মুৎসুদ্দি শ্রেণির
বিকাশঃ
একই ধরনের দুর্বলতা আমরা পাবো আমলা-মুৎসুদ্দি শ্রেণির
বিকাশ ও অবস্থান আলোচনা করার ক্ষেত্রেও।
পূর্ব বাংলার সমাজে আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ
ও তার স্থান সম্পর্কে কোন গভীর আলোচনা ও মূল্যায়ন মাওবাদী আন্দোলন করতে পারেনি।
সাম্রাজ্যবাদ, আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও
সামন্তবাদ- এই তিন মৌলিক শত্রু“কে একদিকে ‘এক ও অবিভাজ্য’ বলা হয়, অন্যদিকে এর
বিরোধিতা করতে গিয়ে এই তিন মৌলিক শত্রু“র পরস্পর জড়ানো ও
নির্ভরশীল সম্পর্ক এবং আমলা-মুৎসুদ্দি শ্রেণির
স্বতন্ত্রতাকে অবহেলা করা হয়।
কম. এসএস মাওকে অনুসরণ ক’রে তাঁর রচনায় ‘আমলাতান্ত্রিক
পুঁজিবাদ’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার
করেছেন। কিন্তু তার কোন ভাল আলোচনা আমাদের পার্টিসহ কোন কেন্দ্রই সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে
করেনি। বরং সমস্ত ধারাগুলোই অভ্যন্তরীণ শত্রু“ শ্রেণি হিসেবে ‘সামন্ত শ্রেণি’-কে গুরুত্ব দেয়।
এ কারণেই মৌলিক দ্বন্দ্বগুলোর আলোচনায় কোথাও আমলা-মুৎসুদ্দি শ্রেণিকে
খুঁজে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় শুধু সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদকে। বিপ্লবকে বলা হয়
সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদবিরোধী বিপ্লব। আমলা-মুৎসুদ্দি শ্রেণিকে
এখানে দেখানো হয় না। যদিও মাওবাদীরাই এদেশে সর্বপ্রথম আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া
শ্রেণিকে বিপ্লবের শত্রু“ শ্রেণি হিসেবে
চিহ্নিত করেছে এবং জাতীয় বুর্জোয়াকে তার থেকে পৃথক করেছে। মাওবাদীরাই তিন শত্রু“ বা ছয় পাহাড়- এ জাতীয় সূত্রায়ন
দ্বারা আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াকে চিহ্নিত
করেছে।
- সুতরাং দেখা যাচ্ছে
যে, দেশীয় অভ্যন্তরীণ শত্রু“ শ্রেণি হিসেবে
আমলা-মুৎসুদ্দি শ্রেণির অবস্থান এবং
আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় তার ভূমিকার ভাল কোন আলোচনা মাওবাদী আন্দোলনের এই প্রথম
পর্বে তেমন একটা হয়নি। বরং তার চেয়ে জোরালো হয়ে উঠে এসেছে সামন্তশ্রেণির
কথা, যাকিনা চীনের মত
হুবহু দেখার একটা প্রবণতা শুরু থেকে মাওবাদী আন্দোলনে বিরাজ করছিল। এটা বাস্তব সম্মত
ছিল না, যদিও গ্রামাঞ্চলে
সামন্তশ্রেণির আলোচনাটা দরকারী অবশ্যই ছিল।
২। বিপ্লবী রাজনীতি
আদি কমিউনিস্ট আন্দোলন, বিশেষত ক্রুশ্চভীয়-মনিসিং সংশোধনবাদের সুদীর্ঘকালীন
সংস্কারবাদ-অর্থনীতিবাদ এবং সংসদীয়বাদের বিপরীতে মাওবাদী আন্দোলন শুরু থেকেই
বিপ্লবী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রমতা দখলের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনীতিকে
আঁকড়ে ধরেছিল। শুধু তাই নয়, তারা মাওবাদী দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের পথকেও গ্রহণ
করেছিল। পাশাপাশি তারা নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিপ্লবী রাজনীতিকেও গ্রহণ করে। এরই অনুসরণে কিছু
আগে বা পরে সবগুলো মাওবাদী ধারাই গ্রামাঞ্চলকে ভিত্তি করে বাস্তব সশস্ত্র সংগ্রাম
গড়ে তোলার পথেও এগিয়ে যায়,
যদিও ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারার
উপলব্ধি ও প্রয়োগের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য ও অসমতা ছিল। তারই ফলশ্রুতিতে ’৭৪-পর্যন্ত বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামের এক মহান জোয়ার সারা
দেশকে প্লাবিত করে।
কিন্তু এই বিপ্লবী রাজনীতিকে গ্রহণ করলেও এ সম্পর্কে
রাজনৈতিকভাবেই বিভিন্ন দুর্বলতা ও বিচ্যুতি মাওবাদী আন্দোলনে বিরাজ করছিল। খোদ বিপ্লবী রাজনীতি
সম্পর্কে উপলব্ধির এই দুর্বলতা এ সময়কার বিপ্লবী আন্দোলন, তথা গণযুদ্ধকে
বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। এগুলো সম্বন্ধে নিচে সংপ্তি আলোচনা করা হলো।
ক) কৃষক সমস্যা, তথা কৃষি বিপ্লবঃ
নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব গ্রহণ করার কারণে মাওবাদী আন্দোলনের
সকল ধারাগুলোই কৃষক সমস্যার কেন্দ্রীয় গুরুত্বকে ও কৃষি বিপ্লবকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব
অনুশীলনে সমগ্র মাওবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা তার বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুতর সমস্যা
দ্বারা আক্রান্ত ছিল। এভাবে বিপ্লবী রাজনীতিকে বেশ পরিমাণে দুর্বল করে
তুলেছিল।
আন্দোলন বিভিন্ন পর্যায়ে ভুলভাবে জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান
দ্বন্দ্ব নির্ধারণ করার কারণে কৃষি বিপ্লবের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব লাইনগতভাবেই কমে গিয়েছিল। আমাদের পার্টিতে
শ্রেণি লাইনের বিচ্যুতির কারণে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিভিত্তি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল তা
কৃষক সমস্যাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা
আরোপ করেছিল। ইপিসিপি-উদ্ভূত অন্য ধারাগুলোতে কৃষক সমস্যাকে দেখা
হয়েছিল অর্থনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমাদের পার্টি ও পূবাকপা গণযুদ্ধকে আঁকড়ে ধরেছিল
এবং বিপ্লবী মতা দখলকে সঠিকভাবেই গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু কৃষকের
আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির প্রশ্নটিতে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। এসব কারণেই “খোদ কৃষকের হাতে জমি”- এই মূল কর্মসূচিটিকে
উল্লেখ করলেও কৃষকের প্রকৃত সমস্যাবলী ও তার ভিত্তিতে কর্মসূচিগুলোতে গভীরভাবে
প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। কৃষি-বিপ্লবকে আঁকড়ে না ধরাটিই এর মূল কারণ। যার ফলে সমগ্র
আন্দোলনেই বিপ্লবী রাজনীতি দুর্বল থাকে, যা আমাদের আন্দোলন ও গণযুদ্ধ কাংখিত মাত্রায়
শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারার একটা বড় কারণ।
খ) বিপ্লবী রাজনীতি ও সশস্ত্র সংগ্রামকে সমার্থক মনে করাঃ
দীর্ঘকালীন সংসদীয়বাদ ও অহিংস অর্থনীতিবাদী-সংস্কারবাদী
পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথকে গ্রহণ করার মাধ্যমে
বিপ্লবী রাজনীতির প্রশ্নে মৌলিক ইতিবাচক উল্লম্ফনমূলক অগ্রগতি ঘটেছিল। কিন্তু এটা সংগ্রাম
ও সংগঠনের রূপের ক্ষেত্রে যতটা স্পষ্ট ছিল, মৌলিক
মতাদর্শগত-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ততটা ছিল না। ফলে
মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনে অতীতের সংস্কারবাদ-অর্থনীতিবাদের সাথে পরিপূর্ণ
বিচ্ছেদের বদলে সংগ্রামের রূপের উপর অধিক গুরুত্ব পড়ে। এর ফলে মাওবাদী
আন্দোলন বিপ্লবী রাজনীতি ও সশস্ত্র সংগ্রামকে সমার্থক মনে করার এক নতুন বিচ্যুতিতে
ভুগতে শুরু করে। এর দ্বিমুখী কুফল আমরা লক্ষ করি গোটা মাওবাদী আন্দোলনে।
একঃ যেকোন সময়ে সশস্ত্র সংগ্রাম না করলেই তাকে বিপ্লবী
রাজনীতি থেকে খারিজ করে দেয়ার সংকীর্ণতাবাদী ভুল। ফলত গণযুদ্ধের
বিপ্লবী প্রস্তুতির গুরুত্বকে না বোঝা। এবং বিভিন্ন বিপ্লবী শক্তি, যারা এখনো সশস্ত্র
সংগ্রামে নেমে পড়েনি, তাদের সাথে একটি
সংকীর্ণতাবাদী বিভেদাত্মক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া।
দুইঃ সশস্ত্র সংগ্রাম করলেই তাকে বিপ্লবী রাজনীতি মনে
করা। ফলত সশস্ত্র সংস্কারবাদের সাথে বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রাম, তথা গণযুদ্ধের
রাজনীতিগত পার্থক্য করতে না পারা।
বিপ্লবী রাজনীতি সম্পর্কে এই অপরিপক্ক উপলব্ধি ব্যাপকভাবে
মাওবাদী আন্দোলনের রাজনীতিকেই দুর্বল করে ফেলেছে। যা আমরা পরবর্তীকালে
আরো যান্ত্রিকভাবে বিকশিত হতে দেখবো।
গ) সশস্ত্র অর্থনীতিবাদ-সংস্কারবাদঃ
উপরোক্ত কারণেই আন্দোলনে একটা সশস্ত্র অর্থনীতিবাদী ও
সংস্কারবাদী বিচ্যুতি শুরু থেকেই ক্রিয়াশীল ছিল। বিশেষত ইপিসিপি/এমএল
ধারার মাঝে আদি অর্থনীতিবাদের ব্যাপক প্রভাবের কারণে, ও তার সাথে বিপ্লবী
বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ না হওয়ায় এই ধারা থেকে উদ্ভূত কেন্দ্রগুলো সশস্ত্র সংগ্রামে
নামলেও গণলাইনের নামে, কৃষকের
আশু/অর্থনৈতিক ইস্যুর আন্দোলনকে তারা যতটা গুরুত্ব দেয় (অবশ্যই এখন সশস্ত্র ধারায়), ততটাই কম গুরুত্ব
দেয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য গণযুদ্ধকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে।
পূবাকপা/সিএম-পন্থী ও পিবিএসপি ধারায় উপরোক্ত ধরনে আদি
অর্থনীতিবাদের ধারাবাহিকতার প্রভাব কম থাকলেও তাদের দ্বারা গৃহীত খতম-লাইনের
নেতিবাচক বিকাশ, এবং ঘাঁটি-প্রশ্নে
অস্বচ্ছতা ও বিচ্যুতি ভিন্ন ধরনে সশস্ত্র সংস্কারবাদ/ অর্থনীতিবাদের জন্ম দেয়। খতম ক্রমান্বয়ে
প্রতিশোধবাদ বা খারাপ লোক উচ্ছেদের এ্যাকশনবাদ রূপে গড়ে উঠতে থাকে এবং বিপ্লবী
মতাদখলের রাজনীতিকে দুর্বল ক’রে দেয়। আর ঘাঁটি থেকে বিচ্যুতি বিপ্লবী মতা দখলকে দূরবর্তী, বা দেশব্যাপী
বিস্তৃতির শর্তাধীন ক’রে ফেলে। এভাবে সশস্ত্র
সংগ্রাম করা সত্ত্বেও বিপ্লবী রাজনীতির স্থলে সংস্কারবাদ গড়ে উঠতে থাকে।
ঘ) শীর্ষ তত্ত্বঃ
সারবস্তুতে অর্থনীতিবাদী এই লাইনটি মাওবাদী আন্দোলনের এই
প্রথম পর্বে প্রধান ধারাগুলোর মাঝে দৃশ্যমান ছিল না, কারণ, প্রত্যেকেই ইতিমধ্যে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়েছিল, কম/বেশি সচেতন বা
অসচেতনভাবে। কিন্তু এই প্রধান ধারাগুলোর বহির্ভূত কিছু কিছু অংশের
মাঝে তখনো তা বিরাজমান ছিল,
যাকে কিছুদিন প্রতিনিধিত্ব করতো জাফর-রনো-মেনন, উমর, দেবেন-বাসার- ইত্যাদি গ্র“পগুলো।
এই ধারাটি কার্যত গণযুদ্ধকে পরবর্তী পর্যায়ের করণীয় হিসেবে
নির্ধারণ করেছিল। জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, সংগ্রামকে
পর্যায়ক্রমে সশস্ত্র পর্যায়ে নেয়া- এ জাতীয় বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের লাইনটা দাঁড়িয়েছিল
এই রকম যে, গণআন্দোলন একটা
পর্যায়ে গড়ে তোলার পর তার শীর্ষে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করা হবে। এক্ষেত্রে তাদের সমস্যাটা এখানে ছিল না যে, সশস্ত্র
সংগ্রাম/গণযুদ্ধ শুরু করার জন্য কিছু রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক প্রস্তুতি প্রয়োজন- এটা মনে করা। বরং তাদের আসল
সমস্যাটি ছিল বিপ্লবী রাজনীতিকে উপলব্ধি না করায়, লেনিনের “কী করিতে হইবে”-কে বুঝতে ও প্রয়োগ করতে না পারায়। ফলে বিপ্লবী রাজনীতিকে
আরোপ করার বদলে তারা এক্ষেত্রে একটি অর্থনীতিবাদী
ধারাকে গ্রহণ করেছিল।
১ম পর্বের উত্থান যখন বিপর্যস্ত হয় তারপর তার সারসংকলনকে
কেন্দ্র করে আরো অনেক কেন্দ্র গড়ে ওঠে যারা এই ধারায় বক্তব্য রাখে। বাস্তবত এটা তখন
প্রধান ধারায় পরিণত হয়ে ওঠে। এই ধারানুসারীরা প্রায় সবাই পরবর্তীকালে
আন্তর্জাতিক মহাবিতর্কের ঝড়ঝাপ্টায় মাওবাদ থেকে সরে পড়ে। তবে মাওবাদী শিবিরের
অভ্যন্তরে এটা থেকে যায়, যা আমরা বিএসডি/এমএল
ধারার মাঝে শেষ পর্যন্ত দেখতে পাই।
৩। গণযুদ্ধ
ক) ঘাঁটি প্রশ্নঃ
মাওবাদী আন্দোলন তার সূচনাতেই দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের পথকে
গ্রহণ করার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি গড়ার কথা ব্যক্ত করেছিল। তারা গ্রামে ঘাঁটি
গড়া এবং গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও-এর রণনীতিকে সঠিকভাবেই তুলে ধরেছিল। কিন্তু বাস্তবত
ঘাঁটি প্রশ্নটিকে বিগত শতকের মাওবাদী আন্দোলন কখনই সাধারণ তাত্ত্বিক স্বীকৃতি
ব্যতীত মূর্ত-নির্দিষ্টভাবে কাজে প্রয়োগের জন্য আঁকড়ে ধরেনি। ফলে এরসাথে যুক্ত
একঝাঁক রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও মতাদর্শগত
সমস্যা দ্বারা বিপ্লবী আন্দোলন আচ্ছন্ন হয় যার দীর্ঘস্থায়ী খারাপ প্রভাব আন্দোলনে
পড়ে। এর কারণ হিসেবে কাজ করেছে গণযুদ্ধের লাইনে ঘাঁটির
গুরুত্বটিকে আমাদের আন্দোলনের ধরতে না পারার সমস্যা ।
- “ঘাঁটি হলো গণযুদ্ধের
সারবস্তু”- এই মাওবাদী/মাওবাদ-সম্মত
সূত্রটি মাও-মৃত্যু পরবর্তীকালে প্রথমে পেরুর পার্টি, এবং পরে ‘রিম’-এর মাধ্যমে বিশ্ব
মাওবাদী আন্দোলনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের মাওবাদী আন্দোলন এ শিাটিকে
রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করেনি। তাকে সামরিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেও তাই ব্যর্থ হয়।
প্রথমদিকে মাওবাদী আন্দোলনে তাত্ত্বিক স্বীকৃতির সাথে
ঘাঁটি-প্রশ্নের যতটাও গুরুত্ব ছিল, বাস্তব অনুশীলন এগিয়ে যাবার প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট
বিশেষ নীতিগুলো গড়ে ওঠার কালে তা থেকে বরং দূরে সরে পড়া হয়। অন্য দুটো ধারা- ইপিসিপি/এমএল ও
বিএসডি/এমএল- যারা ততটা গুরুত্ব
সহকারে কখনই গণযুদ্ধকে উপলব্ধি করেনি ও আঁকড়ে ধরেনি তাদের ক্ষেত্রে-তো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু পিবিএসপি ও পূবাকপা- যারা গণযুদ্ধকে
তুলনামূলক শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল, তারাও বরং মাওবাদী আন্দোলনের এই প্রথম পর্বেই কার্যত
ঘাঁটি-প্রশ্ন থেকে দূরে সরে যায়। আমাদের পার্টি এসএস-নেতৃত্বাধীনে এদেশের বিশেষ
অবস্থার কথা বলে ঘাঁটিকে গণযুদ্ধের সারবস্তু না ক’রে তাকে আঁকড়ে ধরার বদলে বরং দেশব্যাপী সশস্ত্র
সংগ্রাম ছড়ানোকে আঁকড়ে ধরে,
এবং ঘাঁটিকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ভবিষ্যতের বিকাশের হাতে ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে পূবাকপা “অসংখ্য ছোট ছোট
সশস্ত্র সংগ্রামের ঘাঁটি”
তৈরির কথা বলে বাস্তবে খতম-লাইনে সশস্ত্র সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ ও ঘাঁটিকে
একাকার করে ফেলে, এ্যাকশন এলাকা
গেরিলা অঞ্চল ও ঘাঁটির পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং একইভাবে দেশব্যাপী
খতম-সংগ্রাম/সশস্ত্র সংগ্রামকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিকাশ করাকে আঁকড়ে ধরে।
ফলত এই রাজনৈতিক ভ্রান্তি সমগ্র সাংগঠনিক ও সামরিক
পরিকল্পনাকে এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের রণনৈতিক পরিকল্পনা ও কাজকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত
করে। ঘাঁটির লক্ষে রণনৈতিক অঞ্চল
আঁকড়ে ধরার নীতি কার্যত বর্জিত হয়।
আমাদের দেশের কিছু বিশেষ অবস্থা ঘাঁটি-প্রশ্নের রাজনৈতিক ও
সামরিক উপলব্ধির দুর্বলতা সৃষ্টিতে বিশেষ শর্ত দিয়েছে সন্দেহ নেই। সমতলভূমি, ছোট দেশ, ঘনবসতি, পাহাড়-জঙ্গল না থাকা
(পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ অঞ্চলটি বাদে)- এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিঃসন্দেহে সামরিক রণনীতি-রণকৌশল
নির্ধারণে গুরুত্ব সহকারে বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু যে মূল
রাজনৈতিক প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, গণযুদ্ধ/সশস্ত্র সংগ্রাম মতাদখলকে ঘিরে আবর্তিত যদি
না হয়, যার রূপকে অবশ্যই
হতে হবে আগে অনুকূল জায়গায় মতা দখল ক’রে ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা, যাকিনা আমাদের মত
দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের দেশে গুণগতভাবে পৃথক তাৎপর্যসম্পন্ন, তাহলে তা বিপ্লবী
রাজনীতিকে দুর্বল করে দেবে। তাই, গণযুদ্ধ যে দেশে যে সময়েই যে শক্তি নিয়েই শুরু করা
হোক না কেন, তাকে অনুকূল
রাজনৈতিক-সামরিক-ভৌগোলিক অঞ্চলে ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার ল্যকে ঘিরেই আবর্তিত হতে হবে। এটা ভবিষ্যতে
আপনাআপনি গড়ে ওঠার বিষয় নয়,
বরং যুদ্ধের একেবারে সূচনা থেকে, এমনকি তার প্রস্তুতি পর্যায় থেকে এই কর্তব্যকে
কেন্দ্রে রেখে যাবতীয় রাজনৈতিক-সাংগঠনিক-সামরিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তার
ভিত্তিতে যাবতীয় তৎপরতা পরিচালনা করতে হবে।
’৭১-সালের বিশেষ
অবস্থায় আমাদের পার্টি বরিশালের পেয়ারাবাগান অঞ্চলে খুব অল্প একটি সময়ের জন্য ছোট
একটি এলাকায় ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। অন্যান্য মাওবাদী ধারাও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এভাবে
ছোট/বড় ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল বৈ কি। কিন্তু একে অতিরঞ্জিত করা যায় না। কারণ, এটা ঘাঁটি প্রশ্নে
সাধারণ স্বীকৃতির একটা বিশেষ অবস্থার প্রয়োগের চেয়ে খুব একটা উচ্চতর কিছু ছিল না। এটা পার্টিগুলোর
লাইনকে কোনভাবেই বিকশিত করেনি। বরং আমাদের পার্টির ক্ষেত্রে তা নেতিবাচকভাবে বিকশিত হয়েছিল।
’৭১-এর বিশেষ অবস্থায়
যখন রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়েছিল, তখন মতার শূন্যতার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা পূরণের জন্য
শুধু মাওবাদীরাই নয়, বহু শক্তিই পদপে নেয়। এমনকি আওয়ামী ধারার
কাদের সিদ্দিকী বা এ জাতীয় কেউ কেউ পর্যন্ত তাদের মত করে ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে। ’৭১-সালে এই সব
সাময়িক ঘাঁটির তাৎপর্য অবশ্যই কম ছিল না। কিন্তু এটা মাওবাদী
গণযুদ্ধে ঘাঁটির গুরুত্বের সঠিক রাজনৈতিক উপলব্ধির দিকে, এবং সে অনুযায়ী
সামরিক-সাংগঠনিক পরিকল্পনার দিকে বিকশিত হতে ব্যর্থ হয়। আমাদের পার্টিতে
দেখা যায় যে, শত্রু‘র দমন বৃদ্ধি পেলে
পেয়ারাবাগান থেকে পশ্চাদপসরণের পর- যা সঠিক ছিল- বরং দেশব্যাপী ছড়ানো অনেকগুলো ছোট ছোট গেরিলা
অঞ্চল/এ্যাকশন এলাকা হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, যা স্পষ্টতই ঘাঁটি
চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। ঘাঁটির লক্ষে রণনৈতিক
অঞ্চলব্যাপী শক্তি কেন্দ্রীকরণ, একক রাজনৈতিক ও সামরিক কমান্ড গড়ে তোলা, এবং বিস্তৃত গেরিলা
অঞ্চল গড়ে তুলে তাকে উপযুক্ত সময়ে ঘাঁটি প্রতিষ্ঠায় উল্লম্ফন দেয়া- এভাবে আগানো হয়নি। বরং পেয়ারাবাগান
থেকে সরে আসার ও ছড়িয়ে পড়ার সঠিক পদপেটি ঘাঁটি-লাইন থেকে বিচ্যুত হবার যুক্তি
হিসেবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে,
যা পরবর্তীকালে, ’৭৩/’৭৪-সালে আরো
নেতিবাচকভাবে বিকাশলাভ করে। এটা না করলে ’৭১-সালে, এবং ’৭৪-সালে এদেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস ভিন্ন হতে
পারতো।
খ) খতম লাইনঃ
মাওবাদী গণযুদ্ধের এদেশীয় ইতিহাসে খতম লাইন একটা বড় স্থান
দখল করে রয়েছে। আন্দোলনের উত্থানের ইতিহাসে এর অবদানকে উপেক্ষা করা যাবে না।
এই লাইন আবিষ্কার করেছিলেন ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের
প্রতিষ্ঠাতা কমরেড সিএম। তিনি বলেছিলেন খতম হলো একইসাথে শ্রেণি সংগ্রামের
উচ্চ পর্যায় এবং গেরিলাযুদ্ধের সূচনা, যদি গেরিলা কায়দায় সে খতমটা করা হয়।
আমাদের দেশেও গেরিলা যুদ্ধ সূচনার জন্য খতম লাইনকে গ্রহণ
করা হয়েছিল। যদিও আমাদের পার্টি কমরেড এসএস-এর নেতৃত্বে এদেশে
খতম লাইন আসবার একেবারে সূচনাকালে অন্যবিধ উপায়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছিল।
’৭০-সালের ৫ মে
পাকিস্তান কাউন্সিলে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে তা সূচিত হয়। কিন্তু শিগগিরই তিনি
অন্যদের মত খতম লাইন গ্রহণ করে নেন। এবং ’৭০-সাল থেকেই খতম লাইনে যুদ্ধ শুরু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে সশস্ত্র সংগ্রাম সূচনা বা এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে আমাদের পার্টিতে বেশ কিছু স্বতন্ত্রতা থাকলেও খতম লাইন
মূলত এখানে কার্যকর ছিল। পূবাকপা ধারা খতম লাইনকে, সিএম-শিার অংশ
হিসেবে বিশুদ্ধভাবে গ্রহণ করে। অন্য দুটো ধারাও তাদের সশস্ত্র অর্থনীতিবাদী
সংগ্রামের আওতায় খতম-এ্যাকশনকে গ্রহণ ও প্রয়োগ করে। এক কথায় কিছু কিছু
বিভিন্নতা বা স্বতন্ত্রতা থাকলেও এদেশের মাওবাদী আন্দোলন গণযুদ্ধ/সশস্ত্র সংগ্রাম
সূচনার জন্য খতম লাইনকে সাধারণভাবে গ্রহণ করেছিল এটা বললে ভুল হবে না।
শূন্য থেকে বাহিনী গঠন ও সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার জন্য, বিশেষত কৃষকদের নিয়ে, এ্যাকশন হিসেবে খতম
একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষত দীর্ঘকালীন
সংসদীয় শান্তিপূর্ণ সংস্কারবাদী সংশোধনবাদী পথ থেকে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সশস্ত্র
সংগ্রামের প্রকৃত বিপ্লবী ধারা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খতম লাইন এদেশে ও
ভারতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
- কিন্তু খতম লাইনের
অন্তর্গত কিছু সীমাবদ্ধতা ও বিচ্যুতি ছিল যা রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বড় সমস্যা আকারে
আবির্ভূত হতে থাকে।
প্রথমত খতম লাইনকে সশস্ত্র সংগ্রাম সূচনার একটি সাধারণ লাইন
হিসেবে আনাটা ভুল ছিল। অবশ্য আমাদের পার্টি অল্প কিছু দিনের জন্য খতম লাইন
গ্রহণের পূর্বে সশস্ত্র সংগ্রাম সূচনার জন্য গেরিলা এ্যাকশনের অন্যবিধ রূপ প্রয়োগ
করেছিল। কিন্তু পরে কার্যত একে সাধারণ লাইনের মতই সবাই গ্রহণ করে ও প্রয়োগ করে, যদিও তার ব্যাপকতা
বিভিন্ন ধারার মাঝে বিভিন্ন রূপের ছিল।
খতম-লাইনের এই ত্রুটি (সূচনার সাধারণ
লাইন) সশস্ত্র সংগ্রাম সূচনার অন্যান্য রূপকে আড়াল/দুর্বল করে দেয়। শুধু তাই নয়, একবার খতম শুরু হবার
পর তার উপর অত্যধিক গুরুত্ব এসে পড়ে, তাকে রণনৈতিক লাইনের মত প্রয়োগ করা হয়- যা পূবাকপা ধারার
মাঝে আমরা দেখতে পাই, বিশেষত পরবর্তীকালে। আমাদের সহ অন্যান্য
ধারাতেও খতমের আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়।
অবশ্যই একে স্বীকৃতি দিতে হবে যে, খতমের এই আধিক্য
সত্ত্বেও, এবং লাইনগতভাবে
খতমের একটি স্তরকে ভুলভাবে গ্রহণ করে নিলেও এ্যাকশনের অন্যান্য রূপগুলোকে
সৃজনশীলভাবে আবিষ্কার করা ও প্রয়োগ করা, এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে সর্বব্যাপী বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে এই পর্বে কমরেড এসএস সবচেয়ে সৃজনশীল গতিশীল ও সাহসী অবদান
রেখেছিলেন, যা এখনো পর্যন্ত
সবচেয়ে উন্নত মাত্রাকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু একেও
স্বীকৃতি দিতে হবে যে, কমরেড এসএস ধারাও
খতম-লাইনের এই ত্রুটির বাইরে ছিল না। যাকিনা পরবর্তীকালে পরিবর্তিত
বাস্তব ও আত্মগত পরিস্থিতিতে পার্টির সামরিক বিকাশে গুরুতর খারাপ ফল রাখে।
দ্বিতীয়ত, খতম লাইন শুধু সূচনার সাধারণ লাইনটি আনে তা নয়, একটি স্তর পর্যন্ত
একেই এ্যাকশনের একমাত্র রূপ হিসেবে নিয়ে আসে। এ লাইন অবশ্যই
রাষ্ট্রযন্ত্রকে আক্রমণের কথা বলে, কিন্তু তা বলে খতমের পর, তার প্রক্রিয়ায়। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র
উচ্ছেদ, তথা তার প্রধান
উপাদান রাষ্ট্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কেন্দ্রীভূত করণের বিপ্লবী কর্তব্যে
সশস্ত্র সংগ্রামকে কেন্দ্রীভূত করায় রাজনৈতিক-মতাদর্শগত বাধার সৃষ্টি হয়, বিশেষত যখন আমাদের
শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা একটা পর্যায়ক্রমিক বিকাশের অর্থনীতিবাদী
বিচ্যুতিকেও বিকশিত করে তোলে।
তৃতীয়ত, খতম শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতা উচ্ছেদে এবং গণমতা প্রতিষ্ঠার একটা পদক্ষেপ হিসেবে আনার কথা বললেও অবধারিতভাবে এটা অত্যাচারী ও খারাপ
লোককে উচ্ছেদ করবার সংস্কারবাদী/প্রতিশোধবাদী বিচ্যুতির পথকেও খুলে দেয়। এই সংস্কারবাদী
বিচ্যুতি নৈতিক অধপতনের দিকেও যেতে থাকে, যখন কিনা ঘাঁটি-প্রশ্নে বিচ্যুতি থেকে উদ্ভূত
কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইনে দুর্বলতার কারণে পার্টির নেতৃত্বে ও
বাহিনীর শক্তিতে জনগণের ক্ষমতার বদলে পার্টি-বাহিনীর
ক্ষমতা গড়ে ওঠার খারাপ ধারা গড়ে উঠতে থাকে। মাওবাদী আন্দোলনের
প্রথম পর্বেই এ ধরনের বিচ্যুতি দেখা যায়, আমাদের পার্টিতেও, যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধারা-উপধারার মাঝে
ভয়াবহরূপে বিকশিত হয়েছে বলে দেখা যায়।
গ) বাহিনী গঠন ও যুদ্ধের বিকাশঃ
মাওবাদী আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামকে আঁকড়ে ধরলেও বাহিনী
গঠনের ক্ষেত্রে নিম্নপর্যায় থেকে উত্তরণ
ঘটাতে মূলত ব্যর্থ হয়। এটা অবশ্যই যুদ্ধ বিকাশের সাথে জড়িত। কিন্তু বাহিনী গঠনের
সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সুস্পষ্টতার অভাবও
এতে ক্রিয়াশীল ছিল। পক্ষান্তরে আবার বাহিনীর
এ বিকাশ না হতে পারায় তা যুদ্ধের বিকাশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।
শূন্য থেকে বাহিনী ও সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার কারণে ’৭১-এর বিশেষ অবস্থা
বাদে এই প্রথম পর্বের বাহিনী সংস্থান সাধারণভাবে ছিল অনিয়মিত গেরিলাদের বিক্ষিপ্ত সংগঠন আকারে। (বাহিনী, গণসংগঠন, যুক্তফ্রন্ট, কর্মসূচি বাস্তবায়ন
প্রভৃতি প্রশ্নে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী ও জঙ্গল এলাকায় ’৭৪ সালে ও পরবর্তী
কিছু সময়জুড়ে আমাদের পার্টির অনুশীলনে কিছু বিশেষ ধরনের অগ্রসরতার চিত্র ছিল। সে বিষয়ে আমরা পরে
উল্লেখ করবো। এখানে যা আলোচনা করা হচ্ছে তা মূলত সমতল-ভূমির অনুশীলনের
উপর করা হয়েছে)। এ ধরনের বাহিনী দিয়ে রাজনৈতিক কেডারদের নেতৃত্বে
খতম করা যায়, এবং এই প্রথম পর্বে
ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রবাহিনীর উপরেও আক্রমণ করা হয়, বিশেষত আমাদের পার্টিতে। এটা সফলতা ও জোয়ার
আনে, সশস্ত্র শিক্ষাকে কিছুটা এগিয়ে দেয়, গেরিলা কায়দাকে কিছুটা আয়ত্বে আনে। কিন্তু প্রথম থেকেই
প্রধান বাহিনী হিসেবে নিয়মিত গেরিলাদের ইউনিট (নিগেদ) গড়ে তোলার উপর মনোযোগ না
দিয়ে তাকে পরবর্তী স্তরের,
পরবর্তীকালের জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়। এভাবে যদিও সংগ্রামের স্বাভাবিক বিকাশ কিছু কিছূ ক্ষেত্রে নিগেদ গড়ে তুলছিল, কিন্তু তাকে সচেতনভাবে আঁকড়ে ধরে শক্তিশালী করে
তোলা হয় না। বরং আমাদের পার্টি মূলত বিপরীত দিকে হাঁটে। দেশব্যাপী কাজ
বিকাশের স্বার্থে আমাদের পার্টিতে এই প্রক্রিয়াটিকে ’৭৪-সালে এসে দুর্বল
করে ফেলা হয়। ঘাঁটি-প্রশ্নে সমস্যার কারণে রণনৈতিক অঞ্চলে শক্তি
কেন্দ্রীকরণের অভাব এক্ষেত্রে সামর্থ্যের দুর্বলতা আকারেও প্রকাশিত হয়। নিগেদ বিকাশ না
হওয়ার কারণে বাহিনীর চলমানতা গড়ে ওঠে না। সামরিক আত্মরক্ষা বিকশিত না হয়ে তা সাংগঠনিক আত্মরক্ষায় পর্যবসিত হয়। ঠিক একই কারণে শত্রুর দমনে পাল্টা আক্রমণের শক্তিও ভালভাবে গড়ে ওঠে না। ফলে খতম বা
রাষ্ট্রবাহিনীর উপর এক/দু’টি আক্রমণের
পরবর্তীতে নেমে আসা রাষ্ট্রীয় দমনে প্রাথমিকভাবে আত্মরক্ষা সম্ভব হলেও কিছু পরেই সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না। সশস্ত্র সংগ্রাম
বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
নিগেদ গঠনের কোন উদ্যোগ বা তৎপরতা বা সচেতনতা যে
সেসময়ে ছিল না তা নয়। সশস্ত্র সংগ্রাম-এর বিকাশ ও শত্রুর দমন অনিবার্যভাবেই পার্টির সক্রিয় উপাদানদেরকে সশস্ত্র
ইউনিটে একত্রিত ও সংগঠিত করছিল। এটা কিছুটা সচেতনভাবে ও পরিকল্পিতভাবে এবং কিছুটা
স্বতস্ফুর্তভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রের নেতৃত্বে দেশের বহু জায়গাতেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তাকে সচেতন ও
পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নেয়া হয়নি।
‘নিগেদ’ ভালভাবে গড়ে না ওঠাটা
রণনৈতিক অঞ্চলে ঘাঁটির লক্ষে শক্তি কেন্দ্রীকরণ
না করার সাথে যুক্ত একটি সমস্যা আকারে আবির্ভূত হয়। ফলে প্রচুর অস্ত্র
থাকলেও তা অব্যবহৃত পড়ে থাকে। প্রচুর সার্বণিক কর্মী থাকলেও তাদেরকে বাহিনীর
উচ্চতর সংগঠনে বিকশিত করার বদলে আরো আরো জায়গায় ছড়িয়ে দেবার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রচুর কৃষক ও
ছাত্র-তরুণ গেরিলা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে সার্বক্ষণিক গেরিলা হিসেবে দ্রুত টানা হয় না। ফলে সশস্ত্র
সংগ্রামের বিকাশ ও বিপরীতে শত্রু“র ভয়ানক আক্রমণের
সাথে পাল্লা দিয়ে নিগেদ-গঠন বহু পিছিয়ে পড়ে। এমনকি আমাদের
পার্টিতে প্রথমদিকে সচেতনভাবে যেটুকু গড়ে উঠেছিল তাকেও ছড়ানো সাংগঠনিক/সামরিক
কাজের স্বার্থে বলি দেয়া হয়। এভাবে বাহিনী গঠনে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়।
এটা যুদ্ধ বিকাশে মারাত্মক খারাপ ফল দেয়। নিগেদ গঠন এবং
বাহিনীর কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দমনরত শত্রুর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করা ও তার উপর
আক্রমণ চালাতে আমরা ব্যর্থ হই। ব্যর্থ হই বাহিনীকে সেকশন থেকে প্লাটুন, বা আরো উচ্চতর স্তরে
বিকশিত করতে। ব্যর্থ হই দমনরত শত্রুর চলমান ইউনিটের উপর এ্যামবুশ করতে, তাকে মাইনে
পর্যুদস্ত করতে, তার ক্যাম্পগুলোতে রেইড
আক্রমণ করে তা পূর্ণভাবে দখল করতে বা তার ১/২/৪টি সেনাকে হত্যা/জখম করে তার অস্ত্র
ছিনিয়ে নিয়ে শত্রুর উপর আতংক ছড়িয়ে
দিতে, ব্যর্থ হই শত্রুর ছোট ছোট ইউনিটে কমান্ডো আক্রমণ ক’রে অস্ত্র ছিনিয়ে
নেবার ধারা সৃষ্টি করতে। এভাবে যুদ্ধকে উচ্চতর স্তরে বিকশিত করতে আমরা
ব্যর্থ হই, যার বিপুল সম্ভাবনা
সেসময়ে সৃষ্টি হয়েছিল।
* বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে আরেকটি দুর্বলতাকেও আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। তাহলো, যদিও এ পর্বে আমাদের
বাহিনীর ব্যাপক অধিকাংশ ছিল অনিয়মিত গেরিলাদের বিক্ষিপ্ত সংগঠন; বড় জোর কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মিত স্কোয়াড/ইউনিট
গঠন করা হয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাথমিক পর্যায়ে এইসব
গেরিলাকে ইউনিট-ভুক্ত করা এবং গণলাইন বিকাশের প্রক্রিয়ায় গণমিলিশিয়া গড়ে তোলা। গ্রাম/পাড়া ভিত্তিক
কৃষক-জনগণের গণমিলিশিয়া হলো আমাদের বাহিনীর ভিত্তি যা অবিরত নিগেদ-এর নিয়মিত
গেরিলার জোগান দেবে এবং নিগেদ-এর সাথে বিভিন্ন যুদ্ধাভিযান ও লড়াই পরিচালনা করবে। নিগেদ কার্যক্রম
সেভাবে বিকশিত না হওয়াতে এই গণমিলিশিয়ার কাজটিও সঠিকভাবে বিকশিত
হতে পারেনি। যা আমাদের বাহিনী গঠনকে দুর্বল করে দেয়, কারণ, এদুটো একটি অন্যটির
বিকাশের শর্ত সৃষ্টি করে,
এবং একটি অপরটির পরিপূরক।
বাহিনী গঠনের এই সমস্যা বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার সাথে
যুক্তভাবে বিকশিত হয়ে ওঠে। যেমন, আমাদের পার্টিতে গ্রামাঞ্চলে ও শহরে মূল শ্রেণির
মাঝে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে
ভূমিহীন-গরীব কৃষক, কৃষি মজুর ও
অন্যান্য দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ার ক্ষেত্রে সমস্যা, গণলাইন-গণভিত্তির সমস্যা, কর্মসূচি বাস্তবায়নের সমস্যা- যা কিনা
আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণে ডান বিচ্যুতি, ঘাঁটি প্রশ্নে ডান বিচ্যুতি, পার্টি-গঠন ও যুক্ত
ফ্রন্ট গঠনে সংকীর্ণতাবাদী বিচ্যুতি প্রভৃতি রাজনৈতিক সমস্যার থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। অন্যান্য কিছু ধারার
ক্ষেত্রে এটা উদ্ভূত হয়েছিল খোদ গণযুদ্ধের রাজনীতিকে
সঠিকভাবে আঁকড়ে না ধরে কার্যত সশস্ত্র অর্থনীতিবাদী ধারাকে ব্যাপকভাবে ধারণ করার
কারণে। এসব কারণে সবগুলো ধারা বাহিনী গঠনে প্রচেষ্টা চালালেও সেক্ষেত্রে ব্যাপক বাস্তব বাধা গড়ে ওঠে এবং এক্ষেত্রে কাংখিত সফলতা অর্জিত হয়না।
ঘ) রণনৈতিক পরিকল্পনার অভাব
পূর্বেই উল্লেখ হয়েছে ঘাঁটি প্রশ্নে দুর্বলতার কারণে শুরু
থেকেই বাছাইকৃত রণনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলসমূহকে আঁকড়ে ধরা, অঞ্চলসমূহের
সংযুক্তি, অঞ্চলগুলোকে
স্বতঃস্ফুর্ত বিকাশের ভিত্তিতে নয় বরং রণনৈতিক পরিকল্পনার অধীনে বিভিন্ন
ক্যাটাগরীতে বিভক্ত ক’রে তার রাজনৈতিক ও
সামরিক নেতৃত্বের সমস্যার সমাধান করা- এসবের কোন রণনৈতিক পরিকল্পনা মাওবাদী আন্দোলনে ছিল
না।
কিন্তু এছাড়া যুদ্ধ বিকাশের ক্ষেত্রেও যুদ্ধ শুরু করা এবং শুরুর পর তাকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে
নেবার জন্য রণনৈতিক পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাওবাদী আন্দোলন
যুদ্ধকে ঠিক এভাবে কখনই পরিচালনা করতে পারেনি।
শুধুমাত্র কমরেড এসএস ‘বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ’ নামে একটি রণনৈতিক
পরিকল্পনা করেছিলেন ’৭৩-সালে, যা রচিত হয়েছিল
খতমের স্তর থেকে রাষ্ট্রবাহিনীর উপর আক্রমণের স্তরে যুদ্ধকে বিকশিত করার উদ্দেশ্য
নিয়ে। যদিও এতটা স্বচ্ছভাবে ও কেন্দ্রীভূতভাবে তখনও বিষয়টিকে উত্থাপন করা হয়নি। তা সত্ত্বেও মাওবাদী
গণযুদ্ধ গড়ে তোলা ও বিকাশের ক্ষেত্রে এটা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ছিল। আমাদের দেশে গণযুদ্ধ বিকাশে বর্ষাকালীন
সুবিধাগুলোকে বিবেচনা করার এই চেতনাও একটি সৃজনশীল বিকাশকেই প্রতিনিধিত্ব করেছিল। কিন্তু তার সমস্যা
ছিল এই যে, একে ‘বর্ষাকালীন আক্রমণ’ ও ‘শীতকালীন আত্মরা’- এভাবে যান্ত্রিক
বিভক্তিকরণ করা হয়েছিল।
বাস্তবে বর্ষাকাল ছাড়িয়ে শীতকালেও এই আক্রমণাভিযান চলতে
থাকে। এবং পরবর্তী বর্ষাকালেই বরং শত্রুর আক্রমণের মুখে তা
পর্যুদস্ত হওয়া শুরু করে।
এই রণনৈতিক পরিকল্পনার আরো দুর্বলতা ছিল এই যে, ’৭৩-সালে তার আশাতীত
সাফল্যের পরও ’৭৪-সালে একই ধারায়
একই শিরোনামে একই পরিকল্পনা অব্যাহত রাখা হয়, এবং নতুন উচ্চতর কোন
পরিকল্পনা করা হয় না। এভাবে রণনৈতিক পরিকল্পনা রচনার একটা প্রাথমিক সূচনা
হয়েও সে চেতনাকে বিকশিত করা যায়নি। ফলে ’৭৪-সালে বাহিনী ও যুদ্ধ গুণগতভাবে আর এগিয়ে যেতে
ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, এই অভিযানকালেই তা শত্রুর দমনে বিপর্যস্ত হওয়া শুরু করে।
ঙ) গণসংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামঃ
মাওবাদী আন্দোলনের এই প্রথম পর্বে সশস্ত্র সংগ্রামকে আঁকড়ে
ধরার ক্ষেত্রে একতরফাবাদী বিচ্যুতির কারণে
গণসংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামকে মাওবাদী প্রত্যেকটি ধারাই গুরুতরভাবে দুর্বল করে
বসে। যদিও এর মাত্রা বিভিন্ন ধারার মাঝে বিভিন্ন ধরনের ছিল, কিন্তু মৌলিক
সমস্যাটি প্রত্যেকেরই একই ছিল। তা ছিল, গণসংগঠন ও ফ্রন্টের কাজ বিকাশ করতে না পারা, সচেতনভাবে কর্মসূচি
বাস্তবায়নকে কার্যকর করতে না পারা, খণ্ড বা আংশিক সংগ্রামকে কার্যত বর্জন করা, প্রকাশ্য কাজকে মূলত
বর্জন করা, এবং রাজনৈতিক
সংগ্রামের জন্য কৌশলগত কোন কর্মসূচি আনার চিন্তা না করা।
পূবাকপা ধারাটি সিএম-এর অনুসরণে গণসংগঠন-গণআন্দোলনকে গেরিলা
যুদ্ধের জন্য প্রতিবন্ধক মনে করেছে, এবং শুধুমাত্র বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য ও তার সংস্থা হিসেবে গণসংগ্রাম ও
গণকমিটির কথা মনে রেখেছে,
যা আশুভাবে যুদ্ধের নিম্নপর্যায়ের কারণে তারা কখনো প্রয়োগ করার জন্য উদ্যোগ
নিতে পারেনি। ইপিসিপি ও বিএসডি ধারা সশস্ত্র কৃষক গণসংগ্রামকে
গুরুত্ব দিলেও এইসব আশু অর্থনৈতিক (সশস্ত্র) আন্দোলন আর গণযুদ্ধের পার্থক্য করতে
তারা কার্যত ব্যর্থ হয়। পিবিএসপি ধারা বিভিন্ন সময়ে গণসংগ্রাম, গণসংগঠন ও আশু
আন্দোলনের কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে তার কোন প্রকাশ ছিল
না, এবং এসব আলোচনা
গোঁড়ামিবাদী ধরনে মার্কসবাদী কিছু প্রতিষ্ঠিত সত্যের উত্থাপনেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তবে আমাদের পার্টির
এই ধারা তার বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিপ্লবী সশস্ত্র গণআন্দোলনকে হরতালের
মাধ্যমে পরিচালনা করেছিল,
যা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এর বাইরে আর কোন গণসংগ্রামগত তৎপরতা পার্টি গড়ে
তুলতে পারেনি।
বাস্তবে গণআন্দোলনের স্বীকৃতি সত্ত্বেও কীভাবে বিপ্লবী গণআন্দোলন গড়ে তোলা যায়, এবং কীভাবে আর সব
অসংখ্য ধরনের গণআন্দোলনকে গণযুদ্ধের সাথে সমন্বিত করা যায় সে প্রশ্নে অস্পষ্টতাই
এই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
তবে গণআন্দোলন শুধু নিরস্ত্র নয়, সশস্ত্র হতে পারে, হওয়া উচিত, এবং তা গণযুদ্ধের
অংশ হতে পারে, সেটা এই প্রথম পর্বে
উপরোক্ত সংগ্রামগুলোর মাধ্যমে কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার খুবই গুরুত্ব
রয়েছে।
কিন্তু সশস্ত্র ছায়ায় গণসংগ্রামের প্রধান রূপ হলো ক্ষমতা দখল ও বিপ্লবী কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম। সেজন্য জনগণের
বিভিন্ন গণসংগঠন থাকতে হবে,
যার কেন্দ্রীয় বিষয় হবে ক্ষমতার সংস্থা। এ ধরনের গণসংগঠন এবং
তার মাধ্যমে বিবিধ বিপ্লবী গণসংগ্রাম গড়ে তোলায় মাওবাদী আন্দোলন এ পর্যায়ে মূলত
সচেতন ছিল না। বিক্ষিপ্তভাবে ও
স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিভিন্ন ধারার নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় কিছু কিছু এ জাতীয় তৎপরতা গড়ে উঠলেও তা
একটা সামগ্রিক সুসংহত চেতনা ও কর্মধারা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি। এ সমস্যাটি
ঘাঁটি-প্রশ্নে সামগ্রিক বিচ্যুতি ও তা থেকে উদ্ভূত কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও জনগণের ক্ষমতা দখলের কার্যক্রম গড়ে না তোলার সমস্যার সাথে যুক্ত ছিল।
কিন্তু তা ছাড়া অন্যবিধ গণসংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামের
গুরুত্বও খুবই বেশি। সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে ওঠার পূর্বে এর যেমন গুরুত্ব
রয়েছে, তা গড়ে উঠলে পরে তার
বিকাশের স্বার্থে ও টিকে থাকবার জন্যও এর গুরুত্ব রয়েছে। যুদ্ধের অঞ্চলগুলোকে
ঘিরে সারা দেশজুড়ে এ ধরনের বহুবিধ গণসংগঠন ও গণআন্দোলন গণযুদ্ধকে টিকিয়ে রাখা ও
বিকাশের জন্য খুবই নির্ধারক এক শক্তি। বিশেষত শহরাঞ্চলে এই ধরনের বহুবিধ গণসংগঠন
গণসংগ্রাম এবং জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক সংগ্রাম ব্যতীত গড়ে ওঠা যুদ্ধ টিকিয়ে রাখা ও
বিজয়ের দিকে পরিচালনা করা আজকের পর্যায়ে এক অসম্ভব কাজ। যদি আমরা আমাদের
দেশের ভৌগোলিক, জাতিগত, এবং বর্তমানের
আর্থ-সামাজিক বিশেষত্বগুলোকে মনে রাখি তাহলে এর গুরুত্ব বিশেষভাবে বেড়ে যাবে। এইসব সংগঠন সংগ্রাম
হতে পারে যেমন আদর্শগত ও বিপ্লবী কর্মসূচিভিত্তিক, তেমনি হতে পারে চলতি ও অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া
কেন্দ্রীক। গণযুদ্ধের সমর্থনে, তার বিভিন্নমুখী সহায়তায় সংহতিমূলক অনেক গণসংগ্রাম
করতে হলেও এ ধরনের ভিত্তি পার্টিকে গড়তে হবে, এবং তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। অসংখ্য ধরনের
বিপ্লবী ও সংস্কারমূলক/ অর্থনৈতিক/আশু/আংশিক/খণ্ডিত আন্দোলনের সংগঠন সংগ্রামের বহুবিধ নিরাপত্তা-জালের মধ্যেই
শুধু পার্টি ও বাহিনীকে নিরাপদে সংরক্ষণ করা ও বৃদ্ধি করা
সম্ভব।
- তাসত্ত্বেও এটা উলেখ
করা উচিত যে, মাওবাদী আন্দোলনের
এই প্রথম পর্বে বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রাম নিঃসন্দেহেই ব্যাপক জনগণের সমর্থনধন্য ছিল
এবং তার ভাল গণভিত্তি ছিল। কিন্তু তার সংগ্রামী জোয়ারের তুলনায় ব্যাপক সমর্থক
জনগণকে সে কার্যকরভাবে সংগঠিত করতে পারেনি। এবং সর্বেক্ষেত্রে সর্বমুখী গণসংগ্রাম ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সম্মিলিত এক ধারা
সৃষ্টি করতে পারেনি। এটা সশস্ত্র সংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলে তাকে সামরিকভাবে
বিপর্যস্ত করায় শত্রুকে বিরাট সুবিধা করে
দিয়েছে, যা এসময়কার
গণযুদ্ধের ব্যাপকতম ঢেউটির পরাজয়ের একটি বড় কারণ ছিল।
চ) গণযুদ্ধের
প্রস্তুতি
ষাট-সত্তর দশকে যে উত্তাল দেশীয়-আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক
পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে মাওবাদী আন্দোলন সূচিত হয় এবং বিপ্লবী সংগ্রামের রূপ
হিসেবে গণযুদ্ধ শুরু করা হয় তাতে আশুভাবে তখন গণযুদ্ধের প্রস্তুতির প্রশ্নটি
লাইনগত ও অনুশীলনগতভাবে তেমন কোন গুরুত্ব পায়নি। বরং সেসময় “প্রস্তুতি হয়নি” বক্তব্য দ্বারা একটি
অর্থনীতিবাদী গণসংগঠনবাদী লাইন বিভিন্ন মধ্যপন্থী কেন্দ্রের তরফ থেকে উত্থাপিত হয়, যার সাথে রাপচারের
মাধ্যমে অবিলম্বে গণযুদ্ধ শুরু করার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এর বিপরীতে বিপ্লবী
ধারাগুলো “শূন্য থেকে গণযুদ্ধ
শুরু করা”, “গেরিলা যুদ্ধের মধ্য
দিয়ে কৃষক-জনগণকে জাগরিত করা”- ইত্যাকার মাওবাদী তত্ত্বগুলোকে তুলে ধরেছিল, যা সঠিক ছিল।
কিন্তু এটা স্বীকার করতে হবে যে, গণযুদ্ধের সামগ্রিক
লাইনে “প্রস্তুতি”র প্রশ্নটি যথেষ্ট
গুরুত্ব ধরে। বিশেষত এই পর্বের গণযুদ্ধ যখন সম্পূর্ণভাবে
বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তখন থেকে এ প্রশ্নটি আরো জোরালোভাবে উঠে আসতে থাকে। একইসাথে
আর্থ-সামাজিক যে রূপান্তরগুলো পরবর্তীকালে ঘটেছে (সাম্রাজ্যবাদের আরো অনুপ্রবেশ, পুঁজিবাদের বিকাশ, যাতায়াত যোগাযোগ ও
প্রযুক্তির বিকাশ প্রভৃতি থেকে উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিগুলোতে) তার প্রেক্ষিতে গণযুদ্ধের লাইনের বিকাশের সাথে সাথে প্রস্তুতির প্রশ্নটির
গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। কিন্তু মাওবাদী আন্দোলন তার প্রথম যুগের এ
দুর্বলতাকে অব্যাহত রেখে গণযুদ্ধের লাইনের ত্রুটিগুলো কাটাতে ও তার
বিকাশ সাধন করতে বৃহত্তর সমস্যার মুখোমুখি হয়। বিশেষত আন্দোলন কিছু
তাত্ত্বিক সমস্যার সম্মুখীন হয় যা এই শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত আন্দোলন কাটিয়ে তুলতে
পারেনি, বরং পূর্বতন
দুর্বলতাকে বিচ্যুতির পর্যায়ে বিকশিত করে তোলে বিভিন্ন কেন্দ্র।
“শূন্য থেকে গণযুদ্ধ”- এই সঠিক মাওবাদী
তত্ত্বকে গুরুতর একতরফাবাদী ও যান্ত্রিকভাবে আন্দোলন গ্রহণ করেছিল। ফলে গণযুদ্ধের জন্য
যুদ্ধপূর্ব প্রস্তুতিকে আন্দোলনের পক্ষ থেকে গণযুদ্ধ বর্জন, বিপ্লবী রাজনীতি
বর্জন, তথা মাওবাদ বর্জন
বলে চিহ্নিত করার দিকে এগিয়ে নেয়া হয়। ফলত যুদ্ধের প্রস্তুতির নামে যারা প্রকৃতই মাওবাদ
বর্জিত, গণযুদ্ধের রাজনীতি
বর্জিত সংস্কারবাদ-অর্থনীতিবাদ নিয়ে আসতে চেয়েছিল তাদের মূল রাজনৈতিক সমস্যায়
লাইন-সংগ্রাম কেন্দ্রীভূত করার বদলে তাদের বিরুদ্ধে লাইন-সংগ্রাম কেন্দ্রীভূত হয়
তাদের সংগঠন ও সংগ্রামের রূপের বিরুদ্ধে। এটা সশস্ত্র
সংগ্রামের অভ্যন্তরে বিপ্লবী রাজনীতি সংক্রান্ত সচেতনতাকে দুর্বল করে দেয় এবং
সশস্ত্র অর্থনীতিবাদ/সশস্ত্র সংস্কারবাদ গড়ে তোলে। অন্যদিকে গণযুদ্ধের
বিপ্লবী প্রস্তুতির প্রশ্নটিকে ছুড়ে ফেলে দেয়। গণযুদ্ধসহ বিপ্লবের
লাইন-বিনির্মাণের ও তত্ত্বগত কাজের গুরুত্বকে তা অবহেলা করে। প্রাথমিক হলেও
শক্তিশালী পার্টি গড়ে তোলার গুরুত্বকে তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়।
একইভাবে “গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কৃষক-জনগণকে জাগরিত করা”র মাওবাদী
তত্ত্বটিকেও যান্ত্রিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এবং এভাবে একটি সফল
গণযুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ অন্যান্য ধরনের সংগ্রাম, বিশেষত কৃষকের গণসংগ্রাম-গণসংগঠনের কাজ, এবং অন্যান্য সকল
ধরনের আংশিক ও খণ্ডিত সংগ্রামের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থতা ডেকে নিয়ে আসে। এমনকি জরুরী
রাজনৈতিক সংগ্রামগুলোকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়। এসব কিছুকে কার্যত
বিপ্লব-বর্জনের কাতারে ফেলা হয়। বিগত শতকজুড়ে সবগুলো বিপ্লবী মাওবাদী ধারাই কার্যত
এ ধরনের সমস্যায় ভুগতে থাকে। যদিও এই ধরনের সমস্যা থেকে আমাদের পার্টি বেরিয়ে
আসবার পথে ধাপে ধাপে অগ্রগতি ঘটাতে থাকে, কিন্তু সামগ্রিক রাপচার না হওয়ায়, এবং পাশাপাশি
গণযুদ্ধের লাইনটিকে সামগ্রিকভাবে ও সঠিকভাবে উত্থাপন করতে না পারায় এই পুরনো
সমস্যা থেকে আমাদের পার্টিও বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের পার্টি
বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে এটা উলেখ করতেই হবে যে, এই পুরনো সমস্যায়
সবচেয়ে বেশি আচ্ছন্ন থাকে সমগ্র পূবাকপা ধারা এবং আমাদের পার্টি থেকে বিভক্ত হয়ে
সৃষ্ট নতুন কেন্দ্র এমবিআরএম।
এ সবই পরিবর্তিত ও প্রতিকূল বিশ্ব ও দেশীয় পরিস্থিতিতে
গণযুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিকাজকে এবং শক্ত পার্টি গড়ার কাজকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই প্রস্তুতি-লাইনটি শুধু গণযুদ্ধের পূর্বেই যে
শুধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা নয়; সূচিত গণযুদ্ধকে রক্ষা করা, বিস্তৃত করা ও শক্তিশালী করার কাজেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, এর সাথে রাজনৈতিক
দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত সংগ্রাম-সংগঠনের বিভিন্ন রূপকে যথার্থভাবে কাজে
লাগানোর প্রশ্ন। পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব না বুঝলে আমাদের দেশের বিশেষ
বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রেক্ষিতে গণযুদ্ধকে
দেশব্যাপী বিস্তৃত করা, টিকিয়ে রাখা এবং
তাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই, প্রস্তুতির লাইনটিকে গণযুদ্ধের লাইনের একটি
অপরিহার্য অংশ বলে গ্রহণ করতে হবে।
পার্টি-গঠনের সমস্যা
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাওবাদী আন্দোলন তার সূচনা থেকেই অন্তত প্রধান ৪টি
ধারায় বিভক্ত ছিল, যা পরে আরো বহুধা
বিভক্ত হয়ে পড়ে। মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনের মৌলিক বহু প্রশ্নে
সামগ্রিক সঠিক লাইন নির্মাণ করতে না পারাটাই এর অন্তর্নিহিত কারণ ছিল। যে লাইনের একটা অতি
গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল পার্টি-গঠনের প্রশ্ন।
* সকল প্রকৃত
মাওবাদীদের একটি ঐক্যবদ্ধ ও একক কেন্দ্র গঠনের প্রশ্নটি পার্টি-গঠনের প্রধানতম
একটি বিষয়। মাওবাদী ঐক্যের ইচ্ছা বা আকাংখা, এবং সেজন্য কোন
প্রচেষ্টা এ সময়ে মাওবাদীদের মাঝে ছিল না, বা বিভক্তিগুলো ছিল নেহায়েত ভুল বোঝাবুঝিজনিত বা
নেতৃত্বের কোন্দল উদ্ভূত-
বিষয়টা আদৌ এরকম ছিল না। কিন্তু নিজেকে একমাত্র সঠিক বলে দাবি করা, এই সঠিকতাকে প্রায়
সার্বিক ও সামগ্রিক মনে করা, একে বিকাশমান একটা প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখা, বিশেষত তার প্রাথমিক
পর্যায়ে, এবং বিপরীতে অন্য
কেন্দ্রগুলোকে সংশোধনবাদী মনে করা, এমনকি প্রতিবিপ্লবী প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে আখ্যায়িত
করা বা সেভাবে আচরণ করা- এসবের মাঝে এই
বিভক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শগত-রাজনৈতিক উৎস নিহিত ছিল।
আগেই এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, দুই লাইনের
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাইন ও পার্টির বিকাশ সাধনকে আঁকড়ে ধরা হয়নি। পার্টি/কেন্দ্রগুলো
দুই লাইনের সংগ্রাম যে করেনি তা নয়। কিন্তু আন্তমাওবাদী বিতর্ক ও সংগ্রামগুলো চালিত
হয়েছে সংশোধনবাদবিরোধী বৈরী সংগ্রাম আকারে। ফলে এগুলো লাইনের
বিকাশ ও ঐক্যের বিকাশের বদলে নিজ পার্টিগত বিশুদ্ধতাবাদকে বিকশিত করে এবং অন্যদের
সম্পর্কে বিভেদাত্মক সংগ্রাম, অনেক সময় বিষোদ্গার ও আত্মগত প্রচারে, এমনকি অপপ্রচারে
পর্যবসিত হয়েছে। সমস্ত কেন্দ্রগুলোই কম/বেশি এটা করেছে। তত্ত্বকে ব্যবহার
করা হয়েছে অন্য মতকে পরাজিত করার জন্য, বিতর্ককে বিকশিত করা ও সত্য অনুসন্ধানে তত্ত্বের
প্রয়োজনীয় প্রয়োগ বা তার গভীরতা অর্জনের জন্য নয়।
- এই
মতাদর্শগত-রাজনৈতিক চেতনা প্রতিটি পার্টির নিজ অভ্যন্তরেও প্রযুক্ত ও অনুশীলিত
হয়েছিল। পার্টি-প্রশ্নে মাওবাদের বিকাশকে মূলত বোঝা হয়নি। লেনিনবাদী পার্টি, বা পার্টির বলশেভিকীকরণের
নামে কার্যত স্ট্যালিনীয় পার্টিধারা গড়ে ওঠে- যা বস্তুত স্ট্যালিনীয় পার্টির চেয়ে গুণগতভাবে ছিল
নিচু স্তরের, কার্যত অমার্কসবাদী।
লেনিন পার্টি-প্রশ্নে মার্কসবাদের গুণগত বিকাশ ঘটিয়েছিলেন
মেনশেভিকবাদী উদারনৈতিক বুর্জোয়া মতাদর্শকে বিরোধিতা ও সংগ্রামের মাধ্যমে। তিনি উপদলের
স্বাধীনতার বিপরীতে কঠোর শৃংখলাবদ্ধ এককেন্দ্রীক পার্টি-ধারণাকে তুলে ধরেন, যা কিনা পরিচালিত
হবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতির ভিত্তিতে। এই লেনিনীয় নীতিকেই
মাও চারটি সাংগঠনিক মূলনীতি দ্বারা প্রকাশ করেন, যথা- ব্যক্তি সংগঠনের
অনুগত, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর
অনুগত, নিম্নস্তর
উচ্চস্তরের অনুগত, এবং সমগ্র পার্টি
কেন্দ্রীয় কমিটির অনুগত। এ ধরনের স্বেচ্ছামূলক ও কঠোর শৃংখলাধীন পার্টি
ব্যতীত সুতীব্র শ্রেণি সংগ্রামের ঝড়তরঙ্গে সর্বহারা শ্রেণি ও জনগণকে নেতৃত্ব দেয়া
সম্ভব নয়। লেনিন-পরবর্তীকালে
আরো বহু রাজনৈতিক মতাদর্শিক গুণাবলীসহ পার্টি-প্রশ্নে এ ধরনের রূপান্তরই পার্টির
বলশেভিকীকরণ নামে পরিচিতি পায়। বলশেভিক ধরনের পার্টি বলতে এটাই বোঝায়। লেনিন-পরবর্তীকালে
স্ট্যালিন এ নীতিকে সুদৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন এবং কার্যকর করেন।
মাও সেতুঙ দ্বন্দ্ববাদের বিকাশের প্রক্রিয়ায় পার্টি-প্রশ্নটিকেও
এর আলোকে দেখেন ও ব্যাখ্যা করেন। যা জিপিসিআর-এর প্রস্তুতিকালে ও সময়ে মাও গুণগতভাবে
এগিয়ে নেন। মাও দেখান যে, পার্টিও একটি দ্বন্দ্ব। এতেও সর্বদাই দুই মত, নীতি, কৌশল, পদ্ধতি ও লাইন থাকে। আমরা চাই বা না চাই, এটা হলো বস্তুগত
নিয়মের অধীন একটি বস্তুগত বাস্তবতা। প্রকৃত কমিউনিস্টদের দায়িত্ব হলো পার্টির
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করা নয়, বরং এর সঠিক পরিচালনা করা ও সঠিক মীমাংসা করা। কখনো এই দ্বন্দ্ব
সারবস্তুগতভাবে বৈরী, কখনো-বা অবৈরী। অবৈরী দ্বন্দ্বকে
অবৈরীভাবে মীমাংসা করতে হবে, যা সঠিকভাবে পরিচালনা না করলে তা বৈরীদ্বন্দ্বে পরিণত হয়ে
পার্টি ও বিপ্লবের নিদারুণ ক্ষতি করতে পারে। ঠিক এটাই ঘটেছে বিগত
শতকের মাওবাদী আন্দোলনে, যাকিনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেনিনীয় পার্টি শৃংখলা ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নামে
ঘটেছে। এমনকি সারবস্তুগতভাবে বৈরী দ্বন্দ্বগুলোও একটা পর্যায় পর্যন্ত অবৈরীভাবে
পরিচালনা করা যেতে পারে, এবং তার অবৈরী
মীমাংসাও হতে পারে। পার্টি-অভ্যন্তরস্থ এই দ্বন্দ্ব হলো পার্টি বিকাশের
পরিচালিকা শক্তি। একে সঠিকভাবে পরিচালনার মধ্য দিয়ে একদিকে মূলত সঠিক
লাইন/অবস্থান বিকশিত হয়ে ওঠে- নিজ সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা-অসম্পূর্ণতা ও বিচ্যুতিগুলো
কাটানোর মাধ্যমে, অন্যদিকে ভুল
লাইন/অবস্থান-গুলোর পুনর্গঠন ঘটে। এভাবে উচ্চতর সঠিক মতাবস্থান গড়ে ওঠে এবং তার
ভিত্তিতে পার্টিতে উচ্চতর ঐক্য সৃষ্টি হয়। অসচেতন কমরেডগণ
সচেতন হয়ে ওঠেন, বিভ্রান্ত কমরেডগণ
বিভ্রান্তি কাটিয়ে তোলেন,
পার্টি-ঐক্য দৃঢ়তর হয়ে ওঠে, এবং সচেতন ও অসংশোধনীয় উপাদান থাকলে তা চিহ্নিত হয় ও বর্জিত
হয়। এভাবে লাইন ও মতাবস্থান এবং ঐক্য এগিয়ে চলে নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায়ে। এক ধাপ থেকে আর এক
ধাপে।
সুতরাং মাওবাদী পার্টি-ধারণা লেনিনবাদকে গুণগতভাবে এগিয়ে
নেয়, যা কিনা টুএলএস-এর
মধ্য দিয়ে পার্টির বিকাশ ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতির এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক
স্থাপন করে পার্টি-গঠনের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে একদিকে টুএলএস-এর নামে বুর্জোয়া উদারনৈতিকতাকে সংগ্রাম
করার কর্তব্যও উপস্থিত হয়,
যেমন কিনা অন্যদিকে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নামে মনোলিথিক পার্টি-ধারণাকে
সংগ্রাম করার দায়িত্ব আসে। আমাদের মাওবাদী আন্দোলন এ উভয় প্রকার বিচ্যুতি
দ্বারাই আক্রান্ত ছিল। আমাদের পার্টির ক্ষেত্রে বলা যায় যে, শৃংখলার নামে পার্টি তার এ প্রথম পর্বে সম্পূর্ণতই
একটি মনোলিথিক ধরনের পার্টিতে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ‘চক্র’ নির্মূলের নামে
বৈরীভাবে তার মোকাবেলা এবং এমনকি মৃত্যুদণ্ডদানের মত গুরুতর অমার্কসীয় ধারাও এ
সময়ে পার্টিতে গড়ে উঠেছিল,
যাকিনা এসএস-মৃত্যুর অব্যবহিত পর পার্টির মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি হবার মত
নিকৃষ্ট ধরনের লাইন আকারেও বিকশিত হয়ে ওঠে। বাস্তবে এমন একটি
লাইনের ভিত্তি আগেই পার্টিতে বিরাজমান ছিল বলেই প্রতিকূল অবস্থায় ও অপরিপক্ক
নেতৃত্বের অধীনে তা এতটা খারাপভাবে বিকশিত হতে পেরেছিল।
* পার্টি-গঠনে
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার লেনিনীয় নীতিমালাকেও মাওবাদী আন্দোলনে এ সময়ে ব্যাপকভাবে
লংঘন করা হয়। এসএস আমলেই আমাদের পার্টির ইতিহাসে এক সময়ে একসদস্য
বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি বজায় রাখা (যদিও সাময়িকভাবে) এরই একটি খুব খারাপ
দৃষ্টান্ত- যাকিনা
এসএস-পরবর্তীকালের সামগ্রিক বিপর্যয় সৃষ্টিতে বর্ধিত মাত্রা প্রদানে বিশেষ ভূমিকা
রেখেছিল। এ সময়ে পার্টি মূলত পরিচালিত হয়েছে পার্টি কমিটি
দ্বারা নয়, ব্যক্তি পরিচালক
দ্বারা।
যদিও একটি গোপন বিপ্লবী পার্টিতে প্রাথমিকভাবে সদস্যপদ
প্রদান, পার্টি-শাখা গঠন, কমিটি নির্বাচন, যৌথ নেতৃত্ব
ব্যবস্থা গড়ে তোলাটা সহজ নয়। অনেক সময় তাকে সেজন্য একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতেই
হয়। কিন্তু একে যদি পার্টি গঠন ও পরিচালনার নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় তাহলে এ
প্রক্রিয়াটি পার্টিতে অনুসৃত হতে থাকবে। কিন্তু আমাদের
পার্টিতে তার সর্বোচ্চ বিকাশ কালেই এই প্রক্রিয়াগুলো প্রায় ধসে গিয়েছিল এবং
ব্যক্তি পরিচালনার একটা অশুভ রীতি পার্টিতে গড়ে উঠেছিল। এটা কোন শক্তিশালী পার্টির
লক্ষণ নয়, যাকিনা প্রধান ব্যক্তি-নেতৃত্ব এসএস-এর শহীদ হবার
সাথে সাথেই পার্টিতে বিশালভাবে ধস নেমে যাবার একটা বড় কারণ ছিল।
* পার্টি হলো শ্রমিকশ্রেণির অগ্রযোদ্ধা বাহিনী। অবশ্যই পার্টি
শ্রমিক শ্রেণির কোন সাধারণ সংগঠন নয়। এটা হলো তার বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন। এর অর্থ হলো শ্রমিক
শ্রেণির যে চলমান বিপ্লব তাকে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক সংগঠনই হলো পার্টি। তাই, আমাদের মত দেশে
যেখানে বিপ্লবের স্তর নয়াগণতান্ত্রিক যা কিনা সারবস্তুতে কৃষি বিপ্লব- যে বিপ্লবে কৃষক হলো
প্রধান শক্তি, গ্রাম হলো কাজের
প্রধান ক্ষেত্র, সেখানে এ পার্টি স্বভাবতই গড়ে উঠবে প্রধানত গ্রামীণ
সর্বহারা-আধা সর্বহারা শ্রেণি, অর্থাৎ, ভূমিহীন-গরীব কৃষক ও
কৃষি মজুরদের মধ্য থেকে। এবং নাগরিক শিল্পীয় শ্রমিক শ্রেণির মধ্যকার কাজ ও
সংগ্রাম হবে তার চেয়ে গৌণ।
কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে, এই বিপ্লবের নেতা
হলো শ্রমিক শ্রেণি। শ্রমিক শ্রেণি অবশ্যই তার নেতৃত্ব প্রয়োগ করবে তার
রাজনৈতিক পার্টির মাধ্যমে,
যাতে বহু বিভিন্ন শ্রেণির বিপ্লবী উপাদানরা জড়ো হন শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শ ও
রাজনীতিকে গ্রহণ ক’রে; কিন্তু খোদ শ্রমিক
শ্রেণির নিজেকে অবশ্যই সে পার্টিতে শারিরীকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে। কারণ, পার্টি হলো শ্রমিক
শ্রেণির পার্টি।
আধুনিক শ্রমিক শ্রেণি নগরকেন্দ্রীক এবং শিল্পকারখানা
ভিত্তিক। আমাদের দেশে শিল্প বিকাশের অপ্রতুলতার কারণে এই
ধরনের শিল্প কারখানার শ্রমিক সংখ্যায় কম, এবং তাদের একটা অংশ ক্ষুদে বুর্জোয়া চরিত্র বিশিষ্ট হয়ে- লেনিন যাকে বলেছেন
সেরকম “অভিজাত শ্রমিক” হিসেবে গড়ে উঠেছেন। কিন্তু অপরদিকে
অভিজাত শ্রমিকের বাইরে এক বিরাট প্রকৃত সর্বহারা-আধাসর্বহারা শ্রমিক রয়েছেন যারা
সর্বহারা রাজনীতির নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে উঠতে প্রস্তুত। এই শ্রেণিতে ভর্তি
হতে প্রস্তুত সর্বহারা, আধাসর্বহারা শ্রেণির
সংখ্যা আরো বিপুল। যাদের নিজস্ব পার্টি হিসেবে পার্টিকে গড়ে না তুললে
পার্টি তার শ্রেণি চরিত্র থেকে দূরে সরে যাবে।
মাওবাদী আন্দোলন কৃষি বিপ্লব, কৃষক, গ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম আঁকড়ে ধরতে গিয়ে শ্রমিক
শ্রেণির মধ্যকার কাজ থেকে মৌলিকভাবে ও গুরুতরভাবে পিছিয়ে পড়ে। শহরাঞ্চলে ও
শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্নমুখী গণসংগঠন, অর্থনৈতিক/আশু আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগ্রাম কার্যত
মাওবাদী আন্দোলন এ সময়কালে বর্জন ক’রে বসার কারণে শ্রমিক শ্রেণিকে কার্যত ছেড়ে দেয়া হয়
সংশোধনবাদী ও প্রধানত প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে। এ কারণে এক সময়কার
কমিউনিস্ট দ্বারা সৃষ্ট শ্রমিক আন্দোলন দখল করে নেয় বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলরা। আমাদের পার্টির
জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভিত্তি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে
চলে, যা শ্রমিকদের
মধ্যকার কাজ থেকে আমাদেরকে আরো দূরে সরিয়ে নেয়। এটা মাওবাদী
আন্দোলনে বিপুল পরিমাণে ক্ষুদে বুর্জোয়া
মতাদর্শ গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয়, তার নিজ শ্রেণিকে ছেড়ে দেয়া হয় সংশোধনবাদী ও
বুর্জোয়াদের হাতে, যে সমস্যা
পরবর্তীতেও মাওবাদী আন্দোলন কার্যকরভাবে কাটিয়ে তুলতে পারেনি। এই গুরুতর ক্ষতকে সারিয়ে তুলতে মাওবাদী আন্দোলনের নিরলস দীর্ঘস্থায়ী ও
কঠিন প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
* সর্বহারা শ্রেণির পার্টি যেহেতু একটি বিপ্লবী
পার্টি, নিছক সাধারণ কোন
শ্রেণি সংগঠন নয়, তাই, এটা সমাজের সবচেয়ে
নিপীড়িত নিগৃহীত শোষিত শ্রেণি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়- যারা বিপ্লবে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে, যে গোষ্ঠীর তৎপরতা বিপ্লবের জন্য
খুবই প্রয়োজন- তাদের মাঝে গুরুত্ব
দিয়ে কাজ গড়ে তুলতে বাধ্য। তা না হলে বিপ্লবকে সমগ্র সমাজে ব্যপ্ত করা ও
সমাজের সমস্ত অগ্রসর জায়গা থেকে বিপ্লবের শক্তি আহরণ করা, এবং বিশেষত সবচেয়ে
ত্যাগী অগ্রসর উপাদানদেরকে পার্টিতে টেনে এনে পার্টিকে সত্যিকার একটি অগ্রসর বিপ্লবী
পার্টি হিসেবে গঠন করা সম্ভব নয়।
এই দৃষ্টিকোণ ও প্রয়োজন থেকে নারী সমাজ, আদিবাসী, প্রগতিশীল
সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যকার কাজকে বিশেষ গুরুত্বদান করা ও সেখানে
পার্টি গড়ে তোলা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মাওবাদী আন্দোলনে
তেমন কোন সচেতন প্রয়াস দেখা যায়নি। এসএস-নেতৃত্বে আমাদের পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রামে
আদিবাসীদের মাঝে ভাল ভিত্তি গড়তে সক্ষম হলেও সেটা যতনা
নিপীড়িত আদিবাসীদের রাজনৈতিক গুরুত্ব থেকে এসেছিল, তার চেয়ে বেশি এসেছিল সামরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে- পাহাড়-জঙ্গল এলাকার
গুরুত্ব থেকে। তথাপি এই কাজ অবশ্যই রণনৈতিক তাৎপর্যমণ্ডিত ছিল। নারী সমাজে পার্টি
গড়ে তোলার মৌলিক প্রশ্ন হলো নারী প্রশ্নে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি- যা সমগ্র আন্দোলনে
গুরুতরভাবে দুর্বল/বিচ্যুতিসম্পন্ন ছিল। নারী-প্রশ্নের সাথে
যুক্ত বিশেষ সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আঁকড়ে ধরা হয়নি- যেমন, বিয়ে-পরিবার-যৌন
প্রশ্নে সামাজিক মূল্যবোধ থেকে আন্দোলন খুব একটা অগ্রগতি ঘটাতে পারেনি। আমাদের মত পশ্চাদপদ
সমাজে নারীদের মধ্যকার কাজে কিছু বিশেষ সমস্যা থাকলেও নারী-প্রশ্নের বিপুল
গুরুত্বকে বোঝা হয়নি। নারীদেরকে প্রায়ই সমস্যাসংকুল বা সমস্যা সৃষ্টিকারী
বলে মনে করা হয়েছে। বিবাহ ও সন্তানাদির প্রশ্ন, অথবা সমাজে রেখে আসা
পারিবারিক প্রশ্নগুলোকে সঠিকভাবে ধরা হয়নি। প্রেম ও যৌন
প্রশ্নগুলোকে বিশুদ্ধতাবাদীভাবে দেখার কারণে, একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্নকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ও
অতিরঞ্জিতভাবে শৃংখলার আওতায় আনার কারণে বাস্তবে বিপ্লবী স্বার্থ বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসবের ফল স্বরূপ কোন না কোনভাবে পুরুষতান্ত্রিক
দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে আন্দোলনে বজায় ছিল।
প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের অগ্রসরদের একটা
অংশ অবশ্যই সরাসরি কৃষি-বিপ্লবে অংশ নেবেন, এবং পার্টির নেতৃত্ব পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে এগিয়ে
আসবেন। কিন্তু তাদের নিজ কাজের ক্ষেত্র, যেমন- সাংস্কৃতিক কাজ, পত্রিকার কাজ, তত্ত্বগত ও তথ্যগত
গবেষণামূলক কাজ এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও
আলোকপ্রাপ্ত উচ্চবিত্ত অংশকে পার্টির পক্ষে টেনে আনবার কাজের
বিপুল পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। মাওবাদী আন্দোলন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে, ব্যক্তিকেন্দ্রীক কিছু তৎপরতা চালালেও এই
সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগুলোকে কার্যত বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেছে। এভাবে পার্টি গঠনে, পার্টির
বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রসরতা সৃষ্টিতে, সকল নিপীড়িত ও আলোকপ্রাপ্ত অংশকে পার্টির বলয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মাওবাদী আন্দোলন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এভাবে পার্টি-গঠনের
মৌলিক কাজ অসম্পূর্ণ, নিম্নমানের মধ্য
দিয়ে এগিয়েছে, যা কিনা পরবর্তীকালে
পার্টির নেতৃত্বসারির বিভিন্নধর্মী লসের প্রক্রিয়ায় প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে
উপনীত হয়েছে।
* পেশাদার বিপ্লবী গড়ে
তোলা পার্টির গঠনের জন্য একটি মৌলিক প্রশ্ন, যার সঠিক মীমাংসা প্রয়োজন। লেনিন এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন।
পেশাদার বিপ্লবী গঠনের সাথে দুটো বিষয় যুক্ত। একঃ সার্বণিক
বিপ্লবী কর্মী যারা পুরোপুরিভাবে পার্টির ও বিপ্লবী কাজের জন্য নিবেদিত। দুইঃ সর্বহারা
শ্রেণির পার্টি হিসেবে তার নেতৃত্ব কাঠামোকে ব্যক্তিগত মালিকানা ও তার পরিচালনা
থেকে অব্যাহতভাবে মুক্ত করার প্রক্রিয়া রাখা। মাওবাদী আন্দোলনের
প্রথম উত্থান পর্বে মূলত তরুণ ও নবীন বিপ্লবীরা তাদের ব্যক্তিগত সামাজিক জীবন
ত্যাগ ক’রে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে
পড়েছিলেন। যারা তখনো অধিকাংশই কোন ব্যক্তিমালিকানায় জড়িত নন, স্ত্রী/স্বামী বা
সন্তানের সমস্যা থেকে মুক্ত। ফলে এ সমস্যার সাথে জড়িত জটিলতাগুলো সেসময়ে তেমন
একটা গুরুতরভাবে উপস্থিত হয়নি। কিন্তু যখনই কৃষকের মাঝে পার্টি ভিত্তি গাড়তে শুরু
করে, এবং সেখান থেকে
প্রচুর বিপ্লবী বের হবার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন এ প্রশ্নগুলোর মীমাংসা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সাধারণভাবেও পেশাদার
বিপ্লবীর ক্ষেত্রে বহু সময়ই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণিউদ্ভূতদের ব্যক্তিগত সম্পদের প্রশ্ন, পরিবারের প্রশ্ন উঠে
আসে, যার সাথে তাদেরকে
স্থায়ীভাবে ধরে রাখা ও পার্টিগঠনকে এগিয়ে নেয়াটা জড়িত। এই গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়টি এ পর্বে সমগ্র আন্দোলনেই খুব কম আলোচিত হয়েছে। ফলে তা মীমাংসিত
হয়নি। এর কুফল হিসেবে পরবর্তীকালে আন্দোলন যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে তখন বহু কমরেড
ব্যক্তিগত/পারিবারিক ভরণপোষণের জন্য ব্যক্তিগত পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন এবং
কার্যত বিপ্লব থেকে ঝরে গেছেন।
- সর্বহারা শ্রেণীর
বিপ্লবী পার্টির একটি শক্তিশালী বিকাশমান ফান্ড গড়ে তোলা, সামাজিক প্রক্রিয়ার
মধ্যে নিয়মিত আয়ের সংস্থান সৃষ্টি, পেশাদারদের ব্যক্তিসম্পদের সুষ্ঠু পরিকল্পিত
ব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও যাবতীয় বৈষয়িক
প্রশ্নে স্বার্থত্যাগ ও উদ্বুদ্ধকরণই মূল বিষয়, যাকে অবশ্যই কখনো দুর্বল করা উচিত নয়।
যুক্তফ্রন্ট প্রশ্ন
পার্টি, বাহিনী ও ফ্রন্ট- এ তিনটি হলো মাও-বর্ণিত বিপ্লবের তিন যাদুকরী
অস্ত্র (ম্যাজিক উইপন)। এই মাওবাদী সূত্রকে মাওবাদী আন্দোলন সূচনা থেকেই
তত্ত্বগতভাবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ফ্রন্ট-লাইনের বাস্তব প্রয়োগে গুরুতর
দুর্বলতা ও বিচ্যুতি আমরা মাওবাদী আন্দোলনে লক্ষ্য করি যার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল তার এ প্রথম পর্বেই। বিপ্লবের ব্যর্থতার
এটা একটা বড় মৌলিক কারণ হয়ে রয়েছে।
যুক্তফ্রন্ট হলো আন্দোলন ও বিপ্লবী ক্ষমতার সংস্থা। যুক্তফ্রন্টের মৌলিক বিষয় হলো পার্টির নেতৃত্বে
সরাসরি জনগণের বিভিন্ন মিত্র শ্রেণিকে সংগঠিত করা, যারা বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন
ধরনের আন্দোলন সংগঠিত করবেন এবং বিপ্লবী ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত
করবেন। কিন্তু পাশাপাশি যুক্তফ্রন্ট শুধু বিপ্লবী আন্দোলন নয়, সব ধরনের প্রগতিশীল
ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যও কাজ করে বটে। সুতরাং সরাসরি
বিপ্লবী ক্ষমতার সাথে যুক্ত নয়, এমন বহুসব প্রগতিশীল
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্যও যুক্তফ্রন্ট প্রয়োজন। অবশ্য সে সব
আন্দোলনই বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার
সহায়ক হিসেবেই কাজে লাগাতে হবে, এবং তার অধীনেই তাকে রাখতে হবে। এ বিষয়গুলোতে
মাওবাদী আন্দোলনে তেমন একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
একটা প্রবণতা ছিল এই যে, বিপ্লবী ক্ষমতার সংস্থা আকারেই
শুধু একে গড়ে তোলা যায়, এমনকি ক্ষমতা অর্জিত হবার পরে মাত্র (পূবাকপা)। এতে একদিকে ক্ষমতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ফ্রন্টের কাজকে পরবর্তীকালের
কাজ হিসেবে ফেলে রেখে শুধু দুই অস্ত্র- পার্টি ও বাহিনী নিয়ে বিপ্লবী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে
বলা হচ্ছে। এটা মাওবাদ থেকে সরে গিয়েছিল। পার্টির নেতৃত্বে
গণসংগঠন গড়ে তোলার নীতি/পদ্ধতি গড়ে না ওঠাও, কার্যত গণসংগঠনের কাজকে বর্জন করাও, এই প্রশ্নে বাস্তব
সাংগঠনিক কার্যক্রম গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যদিও রাজনৈতিকভাবে
কেউ যুক্তফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তাকে বাদ দেয়নি।
আমাদের পার্টি এসএস-নেতৃত্বে ’৭৩-সালে উপর থেকে
যুক্তফ্রন্ট গঠনের একটি ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল কাগুজে ও গোঁড়ামিবাদধর্মী। এমনকি, বিভিন্ন গণসংগঠনের
যে ঘোষণা তখন দেয়া হয়েছিল সেটাও নিছক কাগুজে ছিল। বাস্তবে গণসংগঠনের
কোন কার্যক্রম গড়ে তোলার নীতি/পদ্ধতি আমাদের পার্টি তখন গড়ে তুলতে পারেনি। বিশেষত
ঘাঁটি-প্রশ্নে বিচ্যুতির কারণে যুদ্ধের বিকাশের প্রক্রিয়ায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও ক্ষমতা দখলের সমস্যা, এবং একই কারণে ও শ্রেণিলাইন-গণলাইনের দুর্বলতা ও
গণসংগঠনের নীতি/পদ্ধতির অভাবে আমরা শক্তিশালী সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলা সত্ত্বেও
এমনকি প্রাথমিক ধরনের গেরিলা অঞ্চলগুলোতেও জনগণের বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন গণসংগঠনে
সংগঠিত করতে ব্যর্থ হই। অন্যদের ক্ষেত্রেও কম/বেশি একই
সমস্যা ঘটেছিল।
- কিন্তু আরো সমস্যা
হয়েছে যুক্তফ্রন্টের কাজকে শুধু পার্টির সরাসরি নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ করে ফেলার কাজের
ধারা থেকে। বিপ্লবের এক সামগ্রিক জোয়ার আসার পূর্ব পর্যন্ত
পার্টির সশস্ত্র অঞ্চলগুলো বাদে পার্টির সরাসরি নেতৃত্বের বাইরেই অধিকাংশ জনগণ সংগঠিত
থাকেন। তাদের সচেতন অংশ সংগঠিত থাকেন অন্যান্য গণতন্ত্রী ও বিপ্লবী সংগঠনে, তাদের একটা বড় অংশ
সংগঠিত থাকেন বিভিন্ন ধরনের সংশোধনবাদী ও সংস্কারবাদী সংগঠনে। মাওবাদী আন্দোলনে
প্রথম পর্বের সময়কালটিতে এটা ব্যাপকভাবে ছিল, কারণ, তখন দেশে ও বিশ্বে একটা উত্তাল বিপ্লবী পরিস্থিতি
বিরাজ করছিল। যুক্তফ্রন্টের লাইন পার্টিকে সক্ষম ক’রে তোলে এইসব জনগণের
সাথে যৌথ আন্দোলন-সমঝোতা-মিত্রতা ও নৈকট্যের সম্পর্ক গড়ে তুলতে, তাদেরকে সচেতন ক’রে তুলতে, বিপ্লবী কর্মসূচির
ভিত্তিতে জনগণের ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে, যা কিনা বিপ্লবী সংগ্রামের পক্ষে বিভিন্নভাবে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। যুক্তফ্রন্ট প্রশ্নে
মাওবাদী আন্দোলন এই ধরনের পদক্ষেপ থেকেও প্রায় দূরেই
সরে ছিল, যদিও খুব মাঝে মাঝে
খুব খণ্ডিত ও সাময়িক কিছু কিছু উদ্যোগ বিভিন্ন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এসেছিল।
- আমরা আগেই দেখিয়েছি
যে, মাওবাদী আন্দোলনের
সূচনাতেই এমনকি মাওবাদী কেন্দ্রগুলো পরস্পরকে সংশোধনবাদী বলার সাথে সাথে
প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী বলার মধ্য দিয়ে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের বৈরী
বিভেদাত্মক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। মাওবাদী বহির্ভূত বিভিন্ন সশস্ত্র সংগ্রামী বা
গণআন্দোলনপন্থী কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে এটা আরো বেশি প্রযোজ্য ছিল। এটা যুক্তফ্রন্টের
কাজে যে এক গুরুতর বাধার সৃষ্টি করেছিল তা বলাই বাহুল্য।
- মাওবাদী আন্দোলন
প্রকাশ্য গণআন্দোলন-গণসংগঠন মূলত বর্জন করেছিল। ৬০/৭০-দশকের এ
সময়টাতে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের পাশাপাশি যে বিরাট ও ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনসহ
বহুমুখী গণআন্দোলনের জোয়ার এদেশে বয়ে যায় তাতে মাওবাদী আন্দোলন তার সামর্থ্যরে
তুলনায় খুবই কম ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। আন্দোলনের এই
সেক্টরে যুক্তফ্রন্ট-লাইনের যে বিশাল গুরুত্ব ছিল তা কার্যত কোন প্রয়োগেই যায়নি।
* রণনৈতিক কর্মসূচির
ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রধান গুরুত্বের সাথে রণকৌশলগত যুক্তফ্রন্টের
প্রশ্নটিকে সমন্বিত করা হয়নি। ফলে তা রণনৈতিক যুক্তফ্রন্টের কাজকে নেতিবাচকভাবে
প্রভাবিত করেছে। পার্টির সরাসরি নেতৃত্বে রণনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে
সংগঠিত করার কাজ হলো একটি স্থায়ী ও দীর্ঘসূত্রী কাজ। এমনকি বিপ্লবী
কর্মসূচির ভিত্তিতে বিভিন্ন পার্টি-বহির্ভূত শক্তির জোট গঠনটিও দীর্ঘস্থায়ী কাজের
মধ্যে পড়ে। কিন্তু ইস্যুভিত্তিক অসংখ্য ধরনের সাময়িক বা
অস্থায়ী জোট গড়ে উঠতে পারে-
বিশেষত গণআন্দোলনে, জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে, প্রকাশ্য কাজে- যার গুরুত্ব অপরিসীম। এধরনের কাজে আংশিক
সংগ্রাম, বা কৌশলগত কর্মসূচির
গুরুত্বকে না বোঝার কারণে এ ক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্টের
লাইনকেও প্রয়োগের প্রশ্ন আসেনি। অথচ পার্টির একক নেতৃত্ব ও উদ্যোগের বদলে এ ধরনের
যৌথ আন্দোলন, এমনকি যুগপৎ আন্দোলন- যুক্ত ফ্রন্ট
লাইনেরই বিভিন্ন প্রয়োগমাত্র। এরা একে অন্যকে এগিয়ে দেয়। এর সুচারু
সংযুক্তকরণ ব্যতীত “যাকেই সম্ভব তাকেই
ঐক্যবদ্ধ কর”- এই মাওবাদী নীতিকে
আমরা প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হবো, যা এ সময়কালে গুরুতরভাবে ঘটেছে। বরং বিপরীতে
যুক্তফ্রন্ট-লাইনের এই ধরনের দুর্বলতা ও বিচ্যুতির কারণে গণতন্ত্রী শক্তির সাথে বা
আন্তঃমাওবাদী বৈরী সংঘর্ষেও মাঝে মাঝে জড়িয়ে পড়তে বা তার উপক্রম হতে দেখা গেছে, যা বিপ্লবী
সংগ্রামকে দুর্বল করেছে, জনগণকে হতাশ করেছে ও
বিভক্ত করেছে।
* জাতিগত আন্দোলনগুলোর
সাথে রণকৌশলগত যুক্তফ্রন্টের বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। এটা জাতি সমস্যার
সঠিক উপলব্ধির সাথে জড়িত বিষয়। জাতিগত আন্দোলনগুলো ক্ষুদে বুর্জোয়া বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে
পরিচালিত। ফলে স্বভাবতই সেগুলোতে বিপুল পরিমাণে সংকীর্ণতাবাদ
এবং কম/বেশি প্রতিক্রিয়াশীলতা বিদ্যমান। কিন্তু একই সাথে তা
প্রধান শত্রু রাষ্ট্রযন্ত্রের
বিরুদ্ধে যুদ্ধরত/সংগ্রামরত বলে তার সাথে আমাদের যুক্তফ্রন্ট গঠন হতে পারে, অথবা সে লাইন থেকে
তাদের প্রতি আমাদের ইতিবাচক আচরণ থাকতে হবে। সংখ্যালঘু
জাতিসত্তার মাঝে পার্টির স্বতন্ত্র কাজ বিকাশের গুরুত্বের পাশাপাশি যুক্তফ্রন্টের
এই প্রশ্নটিকেও গুরুত্ব সহকারে প্রয়োগ করতে হবে। এসএস-নেতৃত্বাধীন
আমাদের পার্টি পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের একাংশের মাঝে ভাল কাজ গড়তে সক্ষম হলেও এক্ষেত্রে সঠিক নীতি দ্বারা
চালিত হতে পেরেছিল সেটা বলা যাবে না। বরং বিপরীতে আমাদের মাঝে পার্টিজান সংকীর্ণতাবাদ
ছাড়াও সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর আন্দোলনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হতে আমরা ব্যর্থ হই। পার্বত্য
চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচি
সঠিকভাবে উত্থাপন করলেও আমাদের পার্টিসহ সমগ্র মাওবাদী আন্দোলন তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, তথা বিচ্ছিন্ন হবার
অধিকারকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়।
** এখানে পার্বত্য
চট্টগ্রাম অঞ্চলে ’৭৪-সাল ও পরবর্তী
কিছু সময়জুড়ে বিশেষ অগ্রসর কিছু অনুশীলনের বিষয়ে আমাদের অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। সেখানে এ সময়ে নিগেদ
গড়ে উঠেছিল, পার্টির নেতৃত্বে
জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের গণসংগঠন ও গণক্ষমতার ভ্রুণ হিসেবে গণকমিটি ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল এবং এভাবে বিপ্লবী
যুক্তফ্রন্টের কাজে অগ্রগতি ঘটেছিল। ফলে গণযুদ্ধকে বিকশিত করা ও ঘাঁটির লক্ষে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে এখানে ইতিবাচক
অগ্রগতি ঘটেছিল। কিন্তু সে সময়ে আমাদের পার্টি এই গুরুত্বপূর্ণ
অগ্রগতিগুলোর বিপুল তাৎপর্যকে সঠিকভাবে উপলব্ধি
করতে পারেনি, তাকে সেভাবে আঁকড়ে
ধরা হয়নি এবং তার থেকে শিক্ষা নিয়ে সাধারণ
নীতি-পদ্ধতি গড়ে তুলে পার্টি-লাইনকে বিকশিত করতে পারেনি। বিশেষত
ঘাঁটি-সংক্রান্ত লাইন ও পার্টি-গঠনের ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও
বিচ্যুতির থেকে এটা উদ্ভূত হয়েছিল। এ কারণেই পার্বত্য-কাজের এসব অগ্রসরতাকেও ভালভাবে
এগিয়ে নেয়ার জন্য সঠিকভাবে আঁকড়ে ধরা যায়নি। পরবর্তীতে এসএস-এর
মৃত্যুর পরই পার্টি ভেঙে যায়, এবং আরো অনেক কারণে এই সংগ্রাম আরো কিছুটা এগিয়ে বিপর্যস্ত
হয়ে যায়।
*** উপরে মাওবাদী
আন্দোলনের সূচনা ও তার প্রথম পর্বের উত্থানকালের আলোচনাটি কিছুটা
বিস্তৃতভাবে করা হয়েছে, কারণ, এটাই আমাদের দেশে
মাওবাদী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীকালে শুধু
দেশীয় আন্দোলনই নয়, সমগ্র বিশ্ব
কমিউনিস্ট আন্দোলন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় এবং একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রতিকূল পরিস্থিতির
মধ্য দিয়ে আন্দোলন পাড়ি দেবার কারণে আন্দোলনের এমনিতর জোয়ার আর কখনো সৃষ্টি হতে
পারেনি। এই উত্থান পরাজিত হবার পর ব্যাপকতম অংশ অধপতিত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক
পর্বে নতুন ক’রে এ আন্দোলন গড়ে
উঠলেও তার মাঝে এই ভিত্তিগুলো থেকে যায় কম/বেশি ক’রে। সুতরাং আজকে যখন একটা সম্পূর্ণ নতুন যুগের সূচনা
হয়েছে- শুধু দেশীয় নয়, বিশ্ব কমিউনিস্ট
আন্দোলনেও, তখন এদেশের মাওবাদী
আন্দোলনের এই ভিত্তিতে যে মৌলিক দুর্বলতা ও বিচ্যুতিগুলো কাজ করেছে তার সুস্পষ্ট
উদ্ঘাটনই প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর উপলব্ধির সাথে
বিগত শতকের সমগ্র যুগের সাথে প্রকৃত রাপচার ঘটানোর সফলতা জড়িত। যাকিনা একটি নতুন
যুগের নতুন কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রথম কাজ।
- এখানে গুরুত্বসহকারে
যা মনে রাখা দরকার তাহলো,
উপরে আলোচিত কিছু ত্রুটি অবশ্যই ছিল
ঐতিহাসিক- যা সে সময়কার মতবাদ
বিকাশের ও তার উপলব্ধির অনিবার্য দুর্বলতা থেকে সৃষ্ট। কিন্তু পাশাপাশি ত্রুটিগুলোর অনেক কিছুই ব্যাপক আকারে ছিল ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণি-চরিত্র উদ্ভূত এবং মালেমা’র উপলব্ধিগত
দুর্বলতা থেকে উদ্ভূত একতরফাবাদ, সংকীর্ণতাবাদ, জাতীয়তাবাদ ও অর্থনীতিবাদ-সংস্কারবাদের সমস্যা থেকে
সৃষ্ট। কিন্তু ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটি যে কারণেই ঘটুক
না কেন, ভুল ভুলই। সেটা তার ছাপ রেখে
গেছে সংগ্রামের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। সুতরাং তার সুস্পষ্ট ও নির্মম উদ্ঘাটন ব্যতীত
বিপ্লব বিকশিত হতে পারে না।
এই প্রথম পর্বের উত্থান সামগ্রিক বিপর্যয়ে নিপতিত হয় ’৭৪-সাল থেকেই। আমাদের পার্টিসহ
বিপ্লবী সংগ্রামগুলো বিপর্যস্ত হতে শুরু করে। কমরেড এসএস-এর
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমগ্র মাওবাদী আন্দোলনের এই বিপর্যয় গুণগতভাবে এগিয়ে যায় বললে
ভুল হবে না। পার্টিগুলো ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। নতুনতর বিভক্তি
আন্দোলনকে গ্রাস করে। আন্দোলনে ব্যাপক নেতৃত্ব শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সামগ্রিক এক হতাশা, ঝরে পড়া, সুবিধাবাদিতা, বিভ্রান্তি, ও এমনকি পথভ্রষ্টতা, অধপতন ও
বিশ্বাসঘাতকতার জন্ম হয়।
এটা ঘটে এমন এক সময়ে যখন মাত্র অল্প পরেই ১৯৭৬-সালের ৯
সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান মাও-এর মৃত্যু এবং চীনের তেংপন্থা ও আলবেনিয়ার হোক্সাপন্থার
বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনও এক সার্বিক বিপর্যয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন রুশ-বিপ্লব পরবর্তী ৬০
বছর পর এই প্রথম তার ঘাঁটি এলাকা হারিয়ে ফেলে, একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র বিহীন হয়ে পড়ে, একটি আন্তর্জাতিক
সাধারণ লাইনের অভাবে ভুগতে থাকে। স্বভাবতই দুনিয়াজোড়া জনগণের বিপ্লবী উত্থানও
বিপর্যস্ত হয়ে যায়, পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। এমন এক সামগ্রিক
বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এ দেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন, তথা মাওবাদী
আন্দোলন-এর সংকট সুগভীরভাবে ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এরই মাঝে এই বিপর্যয়
থেকে বেরিয়ে আসবার নতুন উদ্যোগ আন্দোলনের মধ্য থেকেই জাগরিত হতে থাকে। সেটা হলো এক নতুন
অধ্যায়ের শুরু- দেশে ও বৈশ্বিক
পরিসরে, উভয় ক্ষেত্রেই। ❑
আন্দোলনের মতাদর্শগত
সমস্যাবলী
মতবাদিক লাইনের সাথে মতাদর্শগত বিষয়াবলী ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কিন্তু মতবাদিক
লাইনের আলোচনায় আসে না এমন মতাদর্শিক কিছু বিচ্যুতি/ধারা/প্রবণতাকে আমাদের আলোচনা
করতে হবে পৃথকভাবে। আন্দোলনের এই মতাদর্শিক পুনর্গঠন ছাড়া মতবাদিক
লাইনকে আত্মস্থ করাও কঠিন,
যদিও একে অন্যের পরিপূরক। হতে পারে এইসব মতাদর্শগত সমস্যা শুধু আমাদের দেশেরই
সমস্যা নয়, স্ট্যালিন-পরবর্তী
একটি গোটা পর্যায়ের বিশ্বব্যাপী সাধারণ সমস্যার অন্তত কিছু বিষয়ের সাথে এগুলো জড়িত। সুতরাং মতাদর্শগত
এইসব প্রবণতার আলোচনা বিশ্ব-আন্দোলনের আলোচনাতেও কোন না কোন জায়গায় কোন না কোন মাত্রায়
গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
মাওবাদী আন্দোলনের সবগুলো ধারার মতাদর্শগত প্রবণতা একইরকম
ছিল না। তবে সমগ্রভাবে কিছু সাধারণ সমস্যা/দুর্বলতা/বিচ্যুতি পরিলতি হয় যার কোনটা কোন
পর্বে কোন ধারায় শক্তিশালী ছিল, আর অন্য কোনটি হয়তো ভিন্ন পর্বে ভিন্ন ধারায় জোরালো হয়ে দেখা
দিয়েছিল। আজকের এক নতুন যুগসন্ধিণে নতুনতর সমস্যাও সৃষ্টি
হচ্ছে বটে। কিন্তু বিগত সুদীর্ঘ যুগব্যাপী সমস্যাগুলোকে
ভালভাবে চিহ্নিত না করলে আমরা বর্তমানের নতুনতর সমস্যাগুলোকেও ধরতে পারবো না।
সমস্যাগুলো নিম্বরূপ-
১। প্রয়োগবাদঃ
সমগ্র মাওবাদী আন্দোলন জুড়ে, বিশেষত তার বিপ্লবী ধারায় প্রয়োগবাদ একটি গুরুতর
মৌলিক সমস্যা আকারে বিরাজমান ছিল। মাও-এর ‘অনুশীলন সম্পর্কে’ তত্ত্বকে খুবই যান্ত্রিকভাবে ও একপেশেভাবে গ্রহণ
করা হয়েছিল। এর বিভিন্নমুখী প্রকাশ ও রূপ আমরা দেখতে পাই- যার কয়েকটি নীচে
উল্লেখ করা হলো।
ক) এ্যাকশনবাদ
প্রয়োগবাদের একটা
বিশেষ রূপ হিসেবে সশস্ত্র আন্দোলনে এ্যাকশনবাদ গড়ে ওঠে। এ্যাকশনই সব, লাইন বা
মতাদর্শ-রাজনীতি তেমন একটা বড় বিষয় নয়, অথবা সেগুলো অপ্রয়োজনীয় ও তত্ত্বের কচকচি- এ ধরনের চেতনা
গুরুতররূপে বিকশিত হয় গণযুদ্ধের পরিমণ্ডলে, যা আমরা প্রত্যক্ষ করি বিপ্লবী মাওবাদী আন্দোলনের সবগুলো ধারার মাঝেই। পরবর্তীকালে পূবাকপা
ও এমবিআরএম-এর মাঝে এ সমস্যা গুরুতররূপে বিকশিত হয়ে উঠতে দেখি।
খ) সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ
প্রয়োগবাদ
অবধারিতভাবে সংকীর্ণ অভিজ্ঞাতাবাদে নিজেকে প্রকাশ করে। সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাই
যে সত্য নয়, সত্যে উপনীত হবার
জন্য যে অনুশীলন ও তত্ত্বের, অভিজ্ঞতা ও চিন্তার অনেকগুলো আবর্তনের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়- তা ব্যাপকভাবে বাতিল
হয়ে যায়। অভিজ্ঞতার সারসংকলনকে তত্ত্ব ও নীতির সাথে সংযুক্ত
না করা সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য, যা মাওবাদী আন্দোলনে ব্যাপকভাবে দেখা গেছে।
গ) তত্ত্বের গুরুত্বহীনতা
মাওবাদী আন্দোলনে
তত্ত্বের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে অবনমিত হয়ে যায়। অথবা তাকে মূলতই
মাও-অধ্যয়নে সীমিত করে ফেলা হয়, যদিও এ সময়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মাও-অধ্যয়নের প্রয়োজনকে
অস্বীকার করা যাবে না। এমনকি আমাদের পার্টিতে গোঁড়ামিবাদ বিরোধী
সংগ্রামের নামে এক পর্যায়ে পার্টি-সাহিত্যের বাইরে মালেমা’র বিজ্ঞান অধ্যয়ন, আত্মস্থ করা ও
আলোচনার গুরুত্ব গুরুতরভাবে কমিয়ে ফেলা হয়েছিল। তত্ত্ব ও অনুশীলনের
দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, কখনো কখনো
তত্ত্ব/লাইনের প্রাধান্য-
ইত্যাদি বিষয়গুলোকে প্রায় ভুলে যাওয়া হয়।
২। ব্যক্তিতাবাদঃ
ক) লিন-পন্থার
প্রভাব
ব্যক্তিতাবাদ হলো
বুর্জোয়া/ক্ষুদে বুর্জোয়া
শ্রেণিবৈশিষ্ট্য যা শ্রেণি,
লাইন, পার্টি ও জনগণের
চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এর একটি বিশেষ প্রকাশ ছিল লিনপন্থার মাঝে। জনগণ নয়, ব্যক্তিই ইতিহাস
সৃষ্টি করে- এই হলো লিনপন্থার
সূচনাবিন্দু। পরবর্তীকালে পেরু-পার্টিতে উদ্ভূত ‘জেফেতুরা’ তত্ত্বও এরই একটা বড়
বহিঃপ্রকাশ ছিল।
ইতিহাসে ও বিপ্লবে
ব্যক্তির অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যাকে তুলে ধরা প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তি তার
লাইনগত/রাজনৈতিক ভূমিকা দ্বারাই নেতৃত্বের মর্যাদা পান। তাই, ‘মহান নেতৃত্ব’ বা ‘কর্তৃত্বব্যঞ্জক
নেতৃত্ব’- এ জাতীয় শব্দমালার
মধ্য দিয়ে লাইনের ঊর্ধ্বে তাকে স্থাপন, পার্টির ঊর্ধ্বে তাকে স্থাপন বা গণতান্ত্রিক
কেন্দ্রীকতার বাইরে স্থাপন-এসবই লিনপন্থার
বিভিন্নমূখী প্রকাশ, যা জিপিসিআর-এর
প্রথম পর্বে মাওবাদী আন্দোলনে প্রবেশ করতে পেরেছিল।
‘চিন্তাধারা’ বা ‘শিক্ষা’- এ জাতীয় সূত্রের
মাধ্যমে তাকে মতবাদের স্তরে নিয়ে এসে নেতৃত্বের অবদানকে মতবাদের ঊর্ধ্বে নিয়ে আসা
এই ধরনের ব্যক্তিতাবাদকেই প্রকাশ করে। আমাদের দেশে আমরা এর গুরুতর প্রভাব দেখি এসএস-আমলে
আমাদের পার্টিতে, পূবাকপা ধারার মধ্যে
এবং পরবর্তীকালে এসএস-চিন্তাধারার তত্ত্ব তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
খ) মতাদর্শগত সংগ্রামের নামে ব্যক্তিগত শুদ্ধিকরণ সংগ্রাম
পরিচালনা
ভাল কমিউনিস্ট হবার
লিউ শাওচী-পন্থার প্রভাব- ব্যক্তিতাবাদী এই সমস্যা আমাদের পার্টিতে
ব্যাপকভাবে বিরাজমান ছিল ও রয়েছে। মতাদর্শগত সংগ্রাম, সমালোচনা-আত্মসমালোচনা পার্টির ও কমরেডদের
অসর্বহারা চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি কাটিয়ে তোলার জন্য পার্টির মধ্যে একটি অপরিহার্য
হাতিয়ার। কিন্তু এর নামে প্রায়শই পার্টি-অভ্যন্তরস্থ ব্যক্তি
সংগ্রাম সামনে চলে আসে। এটা রাজনৈতিক সংগ্রাম ও রাজনৈতিক প্রশ্নকে দুর্বল
করে দিয়ে ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে আসে। উপরন্তু ব্যক্তির ছিদ্র অন্বেষণের মধ্য দিয়ে এটা
কমরেডদের মধ্যকার ঐক্যকে বিনস্ট করে, নবীন কমরেডদের হীনমন্য করে ফেলে। এটা প্রকারান্তরে
ব্যক্তিশুদ্ধিকরণের লিউশাওচী-পন্থী মতাদর্শকে পার্টিতে নিয়ে আসে।
৩। অভ্যন্তরীণ ও দুই লাইনের
সংগ্রামকে মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনে কেন্দ্রীভূত না করাঃ
পার্টিকে দুই লাইনের
সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বিকশিত হতে হয়। কারণ, পার্টি অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মতের উদ্ভব ও
দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, যা হলো একটি বস্তুগত
বাস্তবতা। একইসাথে, কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বিভিন্নরূপী সংশোধনবাদের
বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এ সমস্ত
সংগ্রাম প্রায়শই লাইন তথা রাজনৈতিক প্রশ্নে কেন্দ্রীভূত হয়নি। মতাদর্শ ও রাজনীতির
মাঝে মতাদর্শ হলো প্রথম- এই সূত্র দ্বারা
যান্ত্রিকভাবে চালিত হয়ে মতাদর্শগত সংগ্রামকে প্রায়ই রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে
সামনে নিয়ে আসা হয়, রাজনীতিক প্রশ্ন
পিছিয়ে পড়ে, এবং মতাদর্শগত
সংগ্রাম প্রায়ই লাইনগতভাবে না হয়ে মতাদর্শগত শুদ্ধির ব্যক্তিগত সমস্যার
ব্যক্তিতাবাদী সংগ্রামে পর্যবসিত হয়।
বিপ্লবে ভাল মানুষ, ত্যাগী মানুষ, জ্ঞানী মানুষ, সাহসী মানুষ ও দক্ষ মানুষ অবশ্যই দরকার। কিন্তু সর্বোপরি
দরকার বিপ্লবী রাজনীতিতে সজ্জিত মানুষ। এবং এটা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল- কিন্তু পরেরটা হলো
প্রধান। পার্টি হলো প্রথমত রাজনৈতিক সংগঠন। সুতরাং রাজনীতির ক্ষেত্রে ঐকমত্য হলো পার্টি-ঐক্যের ভিত্তি। যাকে আরো সঠিকভাবে
মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইন বলা যেতে পারে।
এ প্রশ্নে স্পষ্টতার অভাব ও অনুশীলনগত ত্রুটি আমরা দেখতে পাই লাইনকে, তথা মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনকে প্রাধান্য না দিয়ে
টেকনিক্যাল প্রশ্নে গুরুত্বদান/অতি জোর প্রদানের মধ্যে। এটা আমাদের দেশের
মাওবাদী আন্দোলনে পার্টি-অভ্যন্তরের সংগ্রামকে ব্যাপকভাবে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। টেকনিক্যাল বিষয়ের
মতপার্থক্যসহ সব কিছুকেই লাইনগত সংগ্রাম বলে কার্যত প্রকৃত লাইনের প্রশ্নকে ঝাপসা
করে দেয়া হয়েছে।
৪। বিশেষ অবস্থার বিশেষ
বিশ্লেষণের নামে নীতি থেকে বিচ্যুতি, এবং নীতির নামে সৃজনশীলতা প্রয়োগে ব্যর্থতা ও
গোঁড়ামিবাদঃ
এ উভয় সমস্যাই মাওবাদী আন্দোলনে বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন সময়ে
প্রভাব বিস্তার করেছিল। আমাদের পার্টির ইতিহাসে প্রথম ধরনের বিচ্যুতির
প্রাধান্য ছিল। বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ ছাড়া মার্কসবাদ হয় না। এটা হলো মার্কসবাদের
জীবন্ত আত্মা। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই এর নাম করেই নীতি থেকে বিচ্যুতিও ঘটে থাকে। আমাদের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী
বিচ্যুতি আসবার ক্ষেত্রে, ঘাঁটি-প্রশ্ন থেকে বিচ্যুতির ক্ষেত্রে এবং পরবর্তীকালের ‘সস পর্যায়’ লাইনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতিগুলো এই
সমস্যা থেকেই ঘটেছিল। অন্যদিকে নীতির নামে বিশেষ অবস্থার বিশেষ
বিশ্লেষণকে বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে গোঁড়ামিবাদী বিচ্যুতিরও
বিস্তর উদাহরণ পাওয়া যাবে।
৫। জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতি, এবংবিদেশী পার্টি/লাইনের
অসৃজনশীল লেজুড়বৃত্তিঃ
মাওবাদী আন্দোলন
জন্ম নিয়েছিল একটা আন্তর্জাতিক-বিহীন অবস্থায়। মাও-এর জীবিতকালে
তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিলুপ্তকরণের সারসংকলন হয়নি এবং নতুন কোন আন্তর্জাতিক গঠনের
উদ্যোগও নেয়া হয়নি। যদিও মাও-নেতৃত্বাধীন চীনা পার্টি আন্তর্জাতিক সাধারণ
লাইন বিনির্মাণে, সোভিয়েত
সমাজতন্ত্রের সারসংকলনে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিল এবং ব্যাপক আন্তর্জাতিকতাবাদী
ভূমিকা রেখেছিল, কিন্তু ‘আন্তর্জাতিক’ গড়ে না ওঠা
আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর মতাদর্শগত ধারায় একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল
সন্দেহ নেই।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বিলুপ্ত করে দেবার পর থেকে বিশ্ব
কমিউনিস্ট আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতির একটা বিশেষ রূপ গড়ে ওঠে। যে যুক্তিগুলোর
ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বিলুপ্ত করা হয়েছিল, সে সব সমস্যার বাস্তবতা থাকলেও এই সিদ্ধান্ত কিছু
ভুল প্রবণতা ও বিচ্যুতিকে গড়ে তোলে। প্রতিটি দেশের পার্টি স্বাধীন, পার্টিগুলোর সম্পর্ক
ভ্রাতৃপ্রতিম, সমান সমান, গুরুশিষ্যের নয়; একটি একক কেন্দ্র
থেকে বিভিন্ন দেশের বাস্তবতা বোঝা ও বিপ্লবের গাইড করা সম্ভব নয়, বিভিন্ন পার্টি একে
অন্যের অভিজ্ঞতা বিনিময় শুধু করবে, কেউ কাউকে মূল্যায়ন করাটা নর্মবিরোধী; প্রতিটি দেশের লাইন
নির্মাণের দায়িত্ব সে দেশের সর্বহারা শ্রেণির, ‘বাইরে’ থেকে কিছু বলাটা সঠিক নয়- ইত্যাকার ভুল চেতনা
শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বের
কমিউনিস্ট আন্দোলনেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের
নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো থেকে এসমস্ত চেতনা গড়ে উঠবার শর্ত পেলেও সারবস্তুতে এসব
চেতনা সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিকের গঠন ও
পরিচালনার নীতি/পদ্ধতিকে গুণগতভাবে উন্নত করার সঠিক পথের বদলে তাকে বিলুপ্ত করে
দেবার ভুল পথ গ্রহণ করা হয়েছিল। এভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও
জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতির একটি নতুন রূপের উদ্ভব ঘটে। এটা সর্বহারা
শ্রেণীর আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাতিকতাবাদী চরিত্র ও দায়িত্ব, এবং সে কারণে একটি
আন্তর্জাতিক সাধারণ লাইন গড়ে তোলা এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তার ভিত্তিতে ঐক্য ও
সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে অনেক দুর্বল করে দেয়।
- কিন্তু এরই পাশাপাশি
নিজ পার্টির লাইনকে সঠিক প্রতিপন্ন করার জন্য বিদেশী পার্টি বা কমরেডদের
সার্টিফিকেট ব্যবহার করা,
বা সে সবের অসৃজনশীল লেজুড়বৃত্তি করা- এসব বিচ্যুতিপূর্ণ চেতনাও আন্দোলনে ব্যাপক
শক্তিশালী ছিল।এই উভয় ধরনের মতাদর্শগত বিচ্যুতিকে সংগ্রাম না ক’রে কোন সঠিক
আন্তর্জাতিকতাবাদী পার্টি গড়ে তোলা যাবে না।
৬। সামগ্রিকতা ও অংশ, সাধারণ ও বিশেষ, রণনীতি ও রণকৌশল, বিপ্লবী সংগ্রাম ও
আংশিক সংগ্রাম, গোপন কাজ ও প্রকাশ্য
কাজ, সশস্ত্র সংগ্রাম ও
গণসংগ্রাম, গ্রামের কাজ ও শহরের
কাজ, কেন্দ্রীভূত কাজ ও ছড়ানো
কাজ, মূল শ্রেণির কাজ ও
অন্য শ্রেণির কাজ,
পার্টির কাজ ও
ফ্রন্টের কাজ, আদর্শগত কাজ ও রাজনৈতিক কাজ, তাত্ত্বিক কাজ ও
বাস্তব অনুশীলনগত কাজ- এই দ্বন্দ্বসমূহের মীমাংসার ক্ষেত্রে একতরফাবাদ-দ্বন্দ্ববাদের
উপলব্ধি ও প্রয়োগের সমস্যাঃ
প্রায় ক্ষেত্রেই মাওবাদী আন্দোলনে
প্রধান প্রবণতা ছিল উপরোক্ত দ্বন্দ্বগুলোর মীমাংসায় একতরফাবাদের আশ্রয় নেয়া। মাও দ্বন্দ্ববাদ
বিকাশে মৌলিক অবদান রেখেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে মাওবাদী আন্দোলন দ্বন্দ্ববাদ
অধ্যয়ন ও প্রয়োগ করেছে সবচেয়ে কম করে। এর কারণে মাওবাদী আন্দোলনের রণনীতি ও রণকৌশল বিনির্মাণে
গুরুতর ধরনের একতরফাবাদী বিচ্যুতি কাজ করেছে।
৭। দ্বন্দ্ববাদের স্থলে
সমন্বয়বাদঃ
মাওবাদী আন্দোলন তার প্রথম পর্বে মতাদর্শগতভাবে যে
যান্ত্রিক একতরফাবাদের ভিত্তি গেড়েছিল তাকে পরবর্তীকালে আমাদের পার্টিতে কাটিয়ে
তুলবার প্রচেষ্টা নেয়া হয়,
এবং দ্বন্দ্ববাদ উপলব্ধি ও প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটে।
কিন্তু এটা করতে গিয়ে পার্টিতে সমন্বয়বাদের একটা প্রভাব
বেড়ে ওঠে। মতাদর্শগতভাবে সেটা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে
প্রকাশিত দেখা গেলেও তার প্রধান প্রভাব পড়ে কেন্দ্রীয়ভাবে নতুন কিছু রাজনৈতিক ও
সামরিক নীতি ও লাইন গ্রহণের মধ্যে। ‘সস পর্যায়’-লাইন এর একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত।
সমন্বয়বাদ নিজেকে বস্তুর সকল দিক দেখতে পারার মাধ্যমে
দ্বান্দ্বিক হিসেবে প্রকাশ করতে চাইলেও তার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হলো বস্তুর মূল
চরিত্রটিকে উপস্থাপন করতে না পারা। তাই, কোনটা দ্বন্দ্ববাদ, আর কোনটা সমন্বয়বাদ- সে বিচারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি জোর দেয়া
প্রয়োজন কোনটা যান্ত্রিক একতরফাবাদ, আর কোনটা বিপ্লবী মাওবাদ- সে বিচারেও।
৮। প্রধান দ্বন্দ্ব ও মূল
দ্বন্দ্বের প্রশ্নে দার্শনিক দুর্বলতাঃ
মাওবাদী আন্দোলন মাও-এর প্রধান দ্বন্দ্বের তত্ত্বকে গ্রহণ
করেছিল, যা ইতিবাচক ছিল। এক্ষেত্রে প্রথম পর্বে কমরেড এসএস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু মূল
দ্বন্দ্বের প্রশ্নটিকে একই মাত্রায় দুর্বল করে ফেলা হয়। মূল দ্বন্দ্বের
সমাধান ব্যতীত সমাজের মৌলিক পরিবর্তন হয় না। তাই, প্রধান দ্বন্দ্বকে
আঁকড়ে ধরার পাশাপাশি বিপ্লবী রাজনীতির জন্য মূল দ্বন্দ্ব সম্পর্কে সচেতনতা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং মূল দ্বন্দ্ব ও প্রধান দ্বন্দ্বের সম্পর্ক
বিষয়টি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। এর সাথে গুরুত্বপূর্ণ দ্বন্দ্ব, মৌলিক দ্বন্দ্ব, তীব্রতম দ্বন্দ্ব- এইসব শব্দগুচ্ছ
সম্পর্কে স্পষ্টতার অভাব মাওবাদী আন্দোলনে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক ও অনাকাংখিত
বিভক্তির জন্ম দিয়েছিল। এই বিষয়গুলোতে দার্শনিকভাবে স্পষ্টতা প্রয়োজন, যা এখনো ভালভাবে
মীমাংসা হয়নি।
৯। মার্কসবাদী বস্তুবাদী
দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতাঃ
মাওবাদী আন্দোলন আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে রাজনীতির উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু একইসাথে
সমাজের ভিত্তি হিসেবে তার অর্থনৈতিকবিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুতর দুর্বলতা দ্বারা চালিত হয়েছে। মার্কসবাদী
অর্থশাস্ত্র বিষয়ে গুরুত্বহীনতা আন্দোলনে জেঁকে বসে। নসুদীর্ঘদিন এই ধারা অনুসরণের কারণে মার্কসবাদী বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও
পদ্ধতিশাস্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে আন্দোলনে দুর্বলতা
গড়ে ওঠে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়াবলীতে আত্মগতভাবে
সিদ্ধান্ত নেয়ার কুঅভ্যাস ও বিচ্যুতি গড়ে ওঠে। মাওবাদী আন্দোলন
পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এর উপর গুরুত্বারোপ
প্রয়োজন।
১০। যুক্তিবাদঃ
মাওবাদী আন্দোলনে উপরোক্ত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতার
হাত ধরে বিকশিত হয় যুক্তিবাদ। যুক্তি সত্যে উপনীত হবার একটি উপায় বটে, কিন্তু যুক্তিবাদ
যুক্তি-তর্কের উপসংহারকেই সত্য মনে করে। কিন্তু সত্য হলো
বস্তুগত বাস্তবতা, যা বহু সময় আপাতভাবে
যুক্তিহীন মনে হতে পারে।
বিশেষত দুই লাইনের সংগ্রাম ও বিতর্কের ক্ষেত্রে আন্দোলনে, বিশেষত আমাদের পার্টিতে ব্যাপকভাবে যুক্তিবাদের চর্চা হয়েছে। এ সম্পর্কে সচেতনতা
প্রয়োজন। এবং তার পুনর্গঠন প্রয়োজন।
১১। ক্রমান্বয়বাদঃ
মাওবাদী আন্দোলনের প্রথম পর্বে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এবং সশস্ত্র
সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিশ্ব রাজনৈতিক উত্তাল সময়টা পার হবার পর বিশ্ব ও দেশীয়
আন্দোলন এক সামগ্রিক বিপর্যয়ে নিপতিত হয়, এবং একটা দীর্ঘ লয়ে তার পুনরুদ্ধারের দুরূহ কাজ
এদেশের মাওবাদী আন্দোলন হাতে নেয়। সে সময়ে মতাদর্শগতভাবে আন্দোলনে ব্যাপকভাবে ক্রমান্বয়বাদী
বিচ্যুতি গড়ে ওঠে। এর পেছনে বিচ্যুতিপূর্ণ দার্শনিক ভিত্তিও কাজ করেছে।
মার্কসবাদী দর্শন দ্বন্দ্ববাদে বিকাশের একটি নিয়ম হিসেবে
পরিমাণগত বিকাশের প্রক্রিয়ায় গুণগত বিকাশকে তুলে ধরা হতো। দার্শনিক এই
প্রতিপাদ্যের একটা তত্ত্বগত প্রভাব ছিল মতাদর্শগত ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়বাদ বিকাশের ক্ষেত্রে।
যদিও মাও পরে দেখিয়েছিলেন যে, এ নিয়ম (পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন) প্রকৃতি ও
সমাজে দেখা যায় বটে, তবে এটি বিকাশের ক্ষেত্রে বিপরীতের একত্বের মূল নিয়মেরই একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কিন্তু দর্শনে
মাও-এর এই বিকাশকে তত্ত্বগতভাবে গ্রহণ করা সত্ত্বেও মাওবাদী আন্দোলনে ইতিপূর্বকার
পরিমাণগত-গুণগত নিয়মের একটা বড় প্রভাব বজায় ছিল। এরই প্রকাশ ঘটে
ক্রমান্বয়বাদ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে।
ক্রমান্বয়বাদ হলো বিকাশের প্রক্রিয়াকে ধীর লয়ে পরিমাণগত
বিকাশের এক পর্যায়ে তারই ফলশ্রুতিতে আপনা আপনি
গুণগত বিকাশ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এটা সত্য যে, পরিমাণগত পরিবর্তন ব্যতীত গুণগত পরিবর্তন আসে না। কিন্তু বিকাশের
গুণগত প্রশ্নটি হলো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবে পরিমাণগত
পরিবর্তনও আসলে ছোট ছোট উলম্ফন ও গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমেই ঘটে থাকে।
বিশেষত সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিপ্লবী গুণগত পরিবর্তন সচেতন প্রচেষ্টা দ্বারা আরোপ করতে
হয়। এটা পূর্বতন প্রক্রিয়ার সাথে সচেতন বিচ্ছেদ ও পরিকল্পিত উলম্ফনমূলক কাজ ছাড়া
ঘটে না। বিশেষত যুদ্ধের ক্ষেত্রে, যখন আমাদের বিকাশকে
আটকে দেবার জন্য বিপরীত একটা শক্তিশালী শত্রু সক্রিয়, তখন এই রাপচার বা সচেতন
ও পরিকল্পিত উলম্ফন ব্যতীত গুণগত রূপান্তর ঘটে না। ফলে বিপ্লব আটকে যায়। অথবা তার সঠিক ও
দ্রুত বিকাশলাভ ঘটে না। ক্রমান্বয়বাদ দার্শনিকক্ষেত্রে উলম্ফন ও রাপচারকে দুর্বল করে দেয়- যদি-বা তাকে বাতিল না করে। রাজনৈতিকভাবে এটা
সংস্কারবাদী বিচ্যুতি নিয়ে আসে।
১২। নারী-প্রশ্নঃ
নারী-প্রশ্নে সমগ্র মাওবাদী আন্দোলনে গুরুতর দুর্বলতা, সমস্যা ও বিচ্যুতি
বিরাজমান ছিল। যদিও ৮০-দশকে আমাদের পার্টি এক্ষেত্রে মৌলিক অগ্রগতি ঘটায়- যা ধারাবাহিকভাবে বিকাশমান। কিন্তু সামগ্রিকভাবে
বিচার করলে মাওবাদী আন্দোলন এক্ষেত্রে গুণগতভাবে
পশ্চাদপদতার পরিচয়ই দিয়েছে।
নারীদের মধ্যে কাজ করা অথবা নারী কেডার বা যোদ্ধা গড়ে তোলা, আর নারী-প্রশ্ন
সমার্থক নয়। যদিও প্রথমোক্ত কাজগুলো অবশ্যই নারী-প্রশ্নে
অগ্রগতির জন্য গুরুত্ব ধরে। প্রথম পর্বের বিপ্লবী আন্দোলন কম/বেশি পরিমাণে এ
কাজ করেছিল বটে, কিন্তু নারী-প্রশ্নে
তার চেয়ে বেশি কোন অগ্রগতি দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োগে আন্দোলনে তখন ঘটেনি। ফলে নারীর অংশগ্রহণও
আন্দোলনের ব্যাপ্তির তুলনায় ছিল অনেক পেছনে।
নারীমুক্তি বিপ্লবের অধীন অবশ্যই, কিন্তু তার বিশেষ ক্ষেত্রে ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। যার অন্যতম মৌলিক
বিষয় হলো যৌন প্রশ্ন, পরিবার প্রশ্ন, নৈতিকতার প্রশ্ন- যাকে অবশ্যই সামাজিক
মূল্যবোধ থেকে বিপ্লবী বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নবতরভাবে তার নির্মাণ, পুনর্গঠন ও শিার এক
নিরন্তর কাজ চালানো প্রয়োজন- পার্টির ভেতরে তো বটেই, পার্টির বাইরেও জনগণের মাঝে, যেখানে যেভাবে তা
প্রযোজ্য সেভাবে।
কিন্তু এভাবে সমস্যাটিকে উপলব্ধি করা ও আঁকড়ে ধরা হয়নি। বরং বহু সামাজিক
প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গি আন্দোলনে বিরাজমান ছিল। আমাদের পার্টির
প্রথম পর্বে ‘ভ্রষ্টতা’ বিরোধী যে চেতনাকে
বিশেষ গুরুত্বদান করা হয়েছিল তা সামাজিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। এছাড়া প্রেম-বিয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধিকার ও পার্টি-বিপ্লবের স্বার্থ- এ দু’য়ের দ্বন্দ্বের সঠিক
মীমাংসা করতেও পার্টি ব্যর্থ হয়েছে। এসবের জন্য বহু খেসারত পার্টিকে দিতে হয়েছে, বহু ভুল মূল্যায়ন ও
ভুল শাস্তিদানের পদক্ষেপ পার্টি গ্রহণ
করেছে, পার্টিতে ফজলু চক্র
উদ্ভবের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নে পার্টির
ভুল নীতি বড় শর্ত হিসেবে কাজ করেছে, এমনকি ’৭৫-সালে বিপ্লবী আন্দোলনের চরম এক সংকটকালে গুটিকয়
শীর্ষ নেতৃত্বের একজনকে মৃত্যুদণ্ডদানের ভয়ংকর ভুলের মাঝেও এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব
ছিল।
মাওবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারায় কম/বেশি ক’রে নারীদেরকে
বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য একটা বড় শক্তি হিসেবে না দেখে একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখার
কু-ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। প্রেম-বিয়েকে অনেক সময়ই ঝামেলা মনে করা হয়েছে। অনিবার্য সন্তানাদি
ও পারিবারিক সমস্যাকে এড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফলত নারী কেডার সেভাবে
গড়ে ওঠেনি, যারা এসেছেন তারা
অনেকে বাস্তবেই সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয় ধরনের
পুরুষ কমরেডদেরকেও সংশ্লিষ্ট দুই ধরনের কারণে আন্দোলন হারিয়েছে।
অবশ্য পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং নারী-মুক্তির
প্রশ্নে জোরালো অবস্থানের কারণে আমাদের পার্টিতে বর্তমানে পুরুষতান্ত্রিকতা
ভিন্নরূপেও প্রকাশিত হয়, যা সমাজের বুর্জোয়া
রূপান্তর থেকে এসেছে। শাশ্বত প্রেমের চেতনা, সবকিছুর ঊর্ধ্বে
প্রেম, যৌন ও সন্তান
প্রশ্নে বুর্জোয়া অধিকার,
যত্নশীলতার নামে পার্টি-বিপ্লবের স্বার্থের ঊর্ধ্বে
স্ত্রী-স্বার্থের সেবা করা-
ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনে নারীর পাবলম্বনের নামে অবিপ্লবী চেতনা সমাজে বিপুল
পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। যাকিনা আমাদের
পার্টিতেও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নারী-মুক্তির প্রশ্নে এ জাতীয় বিচ্যুতি এবং
স্বার্থবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকেও পার্টিতে ভালভাবে সংগ্রাম করতে হবে এবং
সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
১৩। সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও
বুদ্ধিজীবী প্রশ্নঃ
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে এক
ধরনের সংকীর্ণতাবাদী ও বিভেদবাদী বিচ্ছিন্নতায় ভুগেছে মাওবাদী আন্দোলন। এটা মতাদর্শগতভাবে
ডানবিচ্যুতির ক্ষেত্রে আরো শর্ত দেয়।
চিন্তার জগত এবং সৃজনশীল কর্মের এই ক্ষেত্রগুলোতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিদ্যমান
সমাজব্যবস্থায় এই ক্ষেত্রগুলো নিরংকুশভাবে
বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্তদের দখলে। প্রগতিশীল অংশের মাঝেও ব্যাপকভাবে এই
বুর্জোয়া-মধ্যবিত্ত চেতনার প্রভাব রয়েছে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল ধারার উন্মোচন ছাড়াও বিশেষত জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ এবং
সংস্কারবাদের ব্যাপক প্রভাবকে সংগ্রাম করা একটি দীর্ঘস্থায়ী কাজ। অন্যদিকে প্রকৃতি
বিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞানের সাথে সংযুক্ত করার প্রশ্নটিতেও দীর্ঘস্থায়ী কাজ প্রয়োজন। অবশ্যই আমরা বিপ্লবী
শিল্প সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানী সৃষ্টির উপর জোর দেব। কিন্তু সুদীর্ঘকাল
ধরে তা হবে সংখ্যালঘু। তাই, প্রগতিশীল কর্মের ও কর্মীদের সাথে ধৈর্যশীল সংগ্রাম
ও দীর্ঘস্থায়ী পুনর্গঠনের উপর আমাদের বিশেষ জোর দিতে হবে। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ
বিপ্লবী কাজের অনুমোদন এবং অন্য সবকিছুর স্থূল নিষিদ্ধকরণ দ্বারা আমরা কোন উন্নত
চিন্তাশীল সমাজ ও সৃজনশীল মানুষ গড়তে সম হবো না।
শিল্প-সংস্কৃতি বিপ্লবের জন্য একটা প্রধান হাতিয়ার- এটা মাওবাদী মাত্রই
স্বীকার করেছেন। কিন্তু এই জগতের বিশেষত্বকে আমলে নেয়া হয়নি। বরং শুধুমাত্র
বিশুদ্ধ বিপ্লবী সংস্কৃতি নির্মাণের আকাংখা ও প্রবণতা দ্বারা মাওবাদী আন্দোলন
চালিত হয়েছে। ফলে না হয়েছে যথেষ্ট সংখ্যক উন্নত শিল্প মানের সৃষ্টি, না হয়েছে প্রগতিশীল
ধারার সংস্কৃতির বিপ্লবী পুনর্গঠন; এবং ব্যাপক বুদ্ধিজীবীদেরকে বিপ্লবী পরিমণ্ডলে টেনে
আনা। একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সীমিত বিপ্লবী সংস্কৃতিকাজের জগতে মাওবাদী আন্দোলন
বিচরণ করেছে। এটা আদি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সফলতাগুলোকেও হাতছাড়া
করে ফেলেছে। ফলত তার বুদ্ধিজীবীত্বের বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অন্যদিকে প্রচলিত সংস্কারবাদী, মানবতাবাদী, এমনকি বিনোদনমূলক
সামাজিক সংস্কৃতির বলয় থেকে এমনকি নেতৃত্ব পর্যায়ের কমরেডগণও তেমনভাবে বেরুতে
পারেননি।
এরই প্রকাশ আমরা দেখি সুকান্তের মত প্রগতিশীল সাহিত্যকর্ম
সম্পর্কে মূল্যায়নের নামে এক ধরনের নেতিবাদী ধারণা গড়ে ওঠার মধ্যে। বিপরীতে আমাদের
পার্টির রাজনৈতিক লাইনের জাতীয়তাবাদী বিচ্যুতির প্রভাবে শরৎচন্দ্রকে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক’ লেখক বলে মূল্যায়ন
করবার ডানবিচ্যুতির মধ্যে। এ সবকিছু মাওবাদী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক কাজকে শুধু
সংকীর্ণ গণ্ডিতে আটকে দেয় তাই নয়, তার মাঝে গুরুতর ডানপন্থাও গড়ে উঠবার সুযোগ পায়।
- বিজ্ঞান ও দর্শনের
আবিষ্কার ছাড়া মার্কসবাদ হতে পারতো না। তাই, বিকাশমান বিজ্ঞানকে মার্কসবাদী তত্ত্বে সংযুক্ত
করার প্রশ্নটিকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিতে হবে। এবং বিজ্ঞান ও
দর্শনের প্রশ্নে পার্টিকে সজ্জিত করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। যেক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে।
১৪। সংকীর্ণতাবাদী পার্টিজান মতাদর্শঃ
মাওবাদী আন্দোলন তার সূচনাতেই বহুধাবিভক্ত হয়ে একে অন্যকে
সংশোধনবাদী ও এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল অভিধায় চিহ্নিত করার ভুল মতাদর্শগত-রাজনৈতিক
লাইন গ্রহণ করার পর থেকে অব্যাহতভাবে যতনা বাস্তব তথ্য থেকে, তার চেয়ে বেশি
কল্পিত ধারণা থেকে অন্যদেরকে মূল্যায়ন করার প্রচণ্ড আত্মগতভাব দ্বারা চালিত হয়েছে। এটা তথ্য থেকে সত্য
অনুসন্ধান না করার ভাববাদ/গোঁড়ামিবাদে পর্যবসিত হয়েছে। এবং এভাবে সমগ্র
আন্দোলনে এক গুরুতর সংকীর্ণতাবাদী পার্টি-জান মতাদর্শ গড়ে উঠেছে। এ শতাব্দীর সূচনায় আমাদের পার্টি এ থেকে বেরিয়ে
এলেও এর সামগ্রিক পুনর্গঠন হতে আরো সময় লাগবে। পূবাকপা/লাল পতাকা’র প্রধান নেতৃত্ব
সম্প্রতি এক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়ে
এসেছিলেন সেটাও খুবই আশাব্যঞ্জক ছিল। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তার পার্টি সমগ্রভাবে এতে
কতটা সজ্জিত হতে পারে তা এখনো দেখার বিষয়।
এই ধরনের সংকীর্ণতাবাদী পার্টি-জান মতাদর্শ পার্টির বাইরের
বৃহত্তর জনগণকে দেখা দূরের কথা, বৃহত্তর মাওবাদী আন্দোলনকে এবং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক
আন্দোলনকে অনেক সময় দেখতেই পায়নি। ফলে এটা মাওবাদী ঐক্য এবং যুক্তফ্রন্টের ঐক্যের পথে
এক গুরুতর মতাদর্শগত বাধা হিসেবে কাজ করেছে। এটা নিজ পার্টির ভুল-ভ্রান্তির
দিকে নজর দিতে বাধার সৃষ্টি করেছে। এটা ব্যক্তিগত সংকীর্ণতাবাদ, বিভেদবাদ, বিনয়ের অভাব, শিক্ষাগ্রহণের অভাব, আত্মসমালোচনা বিমুখতা এবং ঔদ্ধত্যের একসারি মতাদর্শগত
সমস্যার জন্ম দিয়েছে।
** সুতরাং
পূর্বোল্লিখিত অতীত-মূল্যায়নের লাইনগত পর্যালোচনার পাশাপাশি এইসব মতাদর্শগত
সমস্যাবলীর উপরও আমাদেরকে নজর দিতে হবে। কারণ, কখনো কখনো মতাদর্শগত
সমস্যাবলীই লাইনগত প্রশ্নে দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করার পথে বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাই, লাইনগত সারসংকলন ও
মতাদর্শগত পুনর্গঠন একটি পাশাপাশি বিষয়। একে একত্রে চালানোর
মধ্য দিয়েই আমরা আন্দোলনকে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করতে পারি। ❑