বিবৃতি


বর্তমান পরিস্থিতির উপর কয়েকটি পয়েন্ট

 (১৩ জানুয়ারী, ২০১৪)

 ১। ৫ জানুয়ারীর তামাশার নির্বাচনসকলের সামনে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির দ্বারা চালিত পঙ্গু বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ভাওতাবাজীকে একেবারে উলঙ্গ করে প্রকাশ করে দিয়েছে।
এমনকি আওয়ামী গলাবাজ নেতা, তাদের দলবাজ বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও বৃহৎ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নির্লজ্জ দালাল অংশটিও কিছুটা লজ্জার সঙ্গে নির্বাচনের দুর্বলতাগুলো গ্রহণ করে নিচ্ছে। তবে তারা ও তাদের প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ নির্লজ্জের মত সংবিধানের দোহাই পাড়ছে। এভাবে বুর্জোয়া সংবিধানটির ভিত্তিতে তথাকথিত আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার স্লোগান সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে। যে সংবিধানের দোহাই পেড়ে হাসিনার সরকার বিগত দুমাস ধরে গণতন্ত্রের যে খেলা দেখিয়েছে সেই সংবিধানকে তারা প্রতি পদে পদে লংঘন করেছে ও করে চলেছে নিজেদের কুক্ষিগত ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে।
 পুরোপুরিভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, গণতন্ত্র নামের শাসকশ্রেণির এই ব্যবস্থা আসলে জনগণের কোন গণতান্ত্রিক শাসন নয়, তাদের কোন ক্ষমতা নয়। এই সংবিধান জনগণের-তো নয়ই, তা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকেও সেবা করে না। এটা পশ্চিমা ধরনের উদারনৈতিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রও নয়। এটা হলো কার্যত এক সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র, যা এখন শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও ভারতের বদৌলতে কার্যত ভিন্নরূপের বাকশালী একদলীয় শাসনে পরিণত হয়েছে। তাদের একাজে সাহায্য করছে ইনু, মেননদের মত চরমভাবে অধপতিত তথাকথিত বামরা।
প্রমাণিত হয়েছে যে, এদেশের বুর্জোয়া ব্যবস্থাটি ব্যাপকভাবে চালায় নিজেদের দালাল শ্রেণিটিকে সামনে রেখে বৈদেশিক প্রভুরা- সাম্রাজ্যবাদীরা ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা। এই শাসক শ্রেণি, বিশেষত হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগের মুখে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এসব শুধু জনগণকে ভাওতা দেয়া ও নিজেদের লুটপাটের ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কিছু নয়। ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপ ও প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া এবার শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের৭১-এর চেতনা আসলে ভারত ও সাম্রাজ্যবাদের, বিশেষত ভারতের দালালী। এদের স্বাধীনতা হলো জাতীয় পরাধীনতা। এদের গণতন্ত্র হলো বাকশালী ফ্যাসিবাদ।
জাতীয় পার্টি ও এরশাদকে নিয়ে যে তামাশা, ষড়যন্ত্র, মিথ্যা ও ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট তৎপরতা এ সরকার করেছে, এবং এই পতিত বদমাইশ স্বৈরশাসকটি নীতি, নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের যে মহিমা প্রদর্শন করেছে তা এদেশের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। বিশ্ব রাজনীতিতেও এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
প্রমাণ হয়েছে যে, আন্দোলনের নামে ও তা দমনের নামে শাসকশ্রেণির বুর্জোয়া পার্টিগুলোর প্রধান দুটো পক্ষই এবং তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা গণবিরোধী কার্যকলাপে মেতে উঠতে পারে, কতটা ফ্যাসিস্ট কায়দায় জনগণকে হত্যা করতে পারে, কতটা প্রতারণা ও মিথ্যা প্রচারে নিয়োজিত হতে পারে।
    একই শাসকশ্রেণির নিজেদের মধ্যকার গোষ্ঠীগত মারামারি যারা এতটা বর্বরতায় ও প্রতারণায় পরিচালনা করতে পারে, তারা জনগণকে, বিশেষত জনগণের প্রকৃত কোন আন্দোলন ও ক্ষমতাকে কীভাবে মোকাবিলা করে ও করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
   
২। নির্বাচনের পরপরই বর্বর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা চিরাচরিত নিয়মে এদের সকল পক্ষের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, যা পত্রপত্রিকার রিপোর্ট ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। যদিও আওয়ামী লীগ, তাদের বুদ্ধিজীবী ও সার্কাস পার্টিতে অধপতিত গণজাগরণ মঞ্চ নামের ডিজিটাল সংগঠনটি এজন্য জামাত/মৌলবাদীদেরকে দায়ী করে চলেছে, কিন্তু এটা-যে নির্বাচনী প্রহসনের পরপরই তাকে মিডিয়া ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের থেকে আড়াল করার এক মোক্ষম সুযোগ আওয়ামী সরকারকে এনে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং এর প্রধানতম বেনিফিসিয়ারী আর কেউ নয়, আওয়ামী লীগ। এর সাথে এমন একটি নির্বাচনের পর যেকোন সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে রক্ষার জন্য এমনকি ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপের পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক। হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজে দায়বদ্ধ প্রগতিশীল শক্তি যতদিন আওয়ামী লীগ ও ভারতের হিন্দু-কার্ডের ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের মুক্ত না করবেন ততদিন তারা এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে পারবেন না। আওয়ামী লীগ ও ভারত দেশকে যেদিকে পরিচালিত করছে তাতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আক্রমণ আগামীতে ক্রমে আরো বাড়বে বই কমবে না। যত তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হবার ঝুকিতে পড়বে তত তারা বেশি বেশি হিন্দু-কার্ড-এর প্রতিক্রিয়াশীল খেলা খেলবে।
   
    ৩। এবারের নির্বাচনের আগেই আমরা মূল্যায়ন করেছিলাম যে, ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রগুলোর (সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ ও সামরিক আমলাতন্ত্র) দ্বারা বাধ্য না হলে হাসিনা সরকার কোন ক্রমেই বিরোধী বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবে না। হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও সরকার নির্বাচনের আগে সংলাপের কথা বলে যে প্রতারণা করেছে, এখনো তাই করছে। এখনো তারা বাধ্য না হলে ৫ বছর শেষ না করে নির্বাচন দেবে না। কুক্ষিগত ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য এমনকি নিজ শ্রেণির অভ্যন্তরেও তারা কোন সমঝোতা তারা চায় না, কারণ তা তাদের ও তাদের প্রভু ভারতের শাসকশ্রেণির স্বার্থকে ক্ষণœ করবে। বিগত নির্বাচনে ২০২১ ভিশনকে এবার তারা-যে ২০৪১-এ পরিবর্তন করেছে সেটা বিনা কারণে নয়। এটা যত না আওয়ামী লীগের কর্মসূচি, তার চেয়ে বেশি করে তা হলো ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের কর্মসূচি। তারা দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের প্রভুত্ব ও আধিপত্যকে কঠোর করার জন্য এক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী চীন- উভয়ের সাথেই দরকষাকষিতে লিপ্ত। একাজে তারা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মত নির্লজ্জ দেশবিরোধী দালাল ও উগ্র ক্ষমতালোভী ফ্যাসিস্ট চাপরাশি পেয়েছে, যা তাদেরকে এবার সফল করেছে। এটা তারা অব্যাহত রাখতেই চাইবে শেষ পর্যন্ত।
৪। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার বন্ধু পশ্চিমা বিশ্ব আওয়ামী লীগ-ভারতের এই কর্তৃত্বকে পছন্দ করেনি। তবে একইসাথে এটা তাদের মৌলিক স্বার্থের পরিপন্থীও হয়নি। ফলে তারা আপাতত এটা মেনে নিয়েছে ও নেবে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দক্ষিণ এশিয়ার মাতব্বরি পুরোপুরি ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে চায়না এটা যেমন ঠিক, তারা ভারতের মাধ্যমেও এ অঞ্চলে তাদের স্বার্থ চালিয়ে যেতে চায়। বিশেষত বিশ্ব রণাঙ্গনে রাশিয়ার সাথে মার্কিনের ক্রমবর্ধিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং উদীয়মান চীনা পুঁজিবাদকে প্রতিরোধ বা বাগে আনায় ভারতকে হাতে রাখা তাদের প্রয়োজন, যার প্রচেষ্টা তারা সর্বদাই করে চলেছে। এক্ষেত্রে তাদের হাতে দুটো কার্ডই রয়েছে। দ্বিতীয়টা যতক্ষণ তাদের মৌলিক স্বার্থকে লংঘন করবে না, ততদিন তাদের দিক থেকে চরম ব্যবস্থায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। মার্কিনের এই দ্বৈত পলিসির ফাঁদে পড়ে বিএনপি জোট এবারকার মত পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে।
তবে আওয়ামী নির্বাচনের চরম গণবিচ্ছিন্নতা, তাদের চরম গণবিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি জোটকে ক্ষমতায় আনার পলিসিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের আপাতত থাকবে।
সাম্রাজ্যবাদীরা, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরীণ এই মরিয়া দ্বন্দ্বকে নিজ স্বার্থে কাজে লাগাতেই বেশি আগ্রহী থেকেছে। বিএনপি-জোটের তীব্র আন্দোলনের মুখে বেসামাল আওয়ামী সরকারকে দিয়ে তারা টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে, যা দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ঝুলন্ত ছিল। আগামীতেও তারা এজাতীয় আরো স্বার্থ হাসিলের ধান্ধায় থাকবে। অন্যদিকে বিএনপি থেকেও তারা তাদের আরো সুবিধা আগে থেকেই আদায় করে রাখবে, যা কিনা আওয়ামী সরকার আমলে তাদের জন্য প্রতিকূল হতে পারে বলে তারা গণ্য করবে।
- রাশিয়া প্রত্যাশিতভাবেই দুর্বল গণসমর্থনের সরকার ও নির্বাচন সত্ত্বেও তাকে তড়িঘড়ি সমর্থন দিয়েছে। মার্কিনের সাথে তার দ্বন্দ্ব ও হাসিনা সরকারের মাধ্যমে অস্ত্র বাণিজ্য, পরমাণু শক্তি প্রভৃতি বিষয়ে রাশিয়ার স্বার্থগত বন্ধন তাকে আওয়ামী সরকারের বন্ধুতে পরিণত করেছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী প্রভু ভারতের বৈদেশিক নীতির প্রভাবও রয়েছে।
- অপরদিকে চীন দ্বৈত নীতি নিয়েছে তার বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য, ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এদেশে তার বাণিজ্যিক অবস্থানকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য, পাশাপাশি মার্কিনের বিপরীতে ভারতের সাথে সখ্যতার পলিসির দ্বারা চালিত হয়ে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে মার্কিনের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে পর্যায়েই থাক না কেন, দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে ভারতের সাথে চীনের বৈরীতা অমীমাংসেয়। তাই, চীন শেষ পর্যন্ত বিএনপি-কেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভাবতে বাধ্য। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্কও কাজ করছে ও করবে। অনুকল যেকোন অবস্থায় চীন বিএনপি-কে মদদ দিয়েছে ও দেবে।
৫। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপিআন্দোলনের নতুন কৌশলহিসেবে হরতাল-অবরোধ স্থগিতকরার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর নেই। বিএনপি কোন বিপ্লবী দল নয় যে, তারা সরকার উচ্ছেদের জন্য অব্যাহতভাবে সহিংস আন্দোলন করে যেতে পারে, মুখে তারা যতই বড় বড় কথা বলুক না কেন। একইসাথে তাদের সহিংস আন্দোলন যে গণবিরোধী কর্মকান্ডের সৃষ্টি করেছে সেটাও তাদের ভোটের রাজনীতির জন্য উপযোগী নয়। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের নসিহতকে কাজে লাগিয়ে নিজ দলকে গুছিয়ে নেবার সুযোগ সে চাইবে। সুতরাং এবারকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে উন্মোচন ঘটেছে তাকে ব্যবহার করে এবং সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে চাপের দ্বারা তারা পরবর্তী সুবিধাগুলো বের করতে চাইছে ও চাইবে।
- পূর্বেই বলা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ বাধ্য না হলে নতুন কোন নির্বাচনে যাবে না। বিশেষত তার জন্য প্রতিকূল ফল হতে পারে এমন কোন সমঝোতায় যাবে না। বরং তারা পূর্বের মতই সংলাপের নামে প্রতারণা চালিয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে তাদের মৌলিক কৌশল।
তবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের চাপ, শাসকশ্রেণির একটা বড় অংশের চাপ বিশেষত সুশীল সমাজ, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও মহলের চাপ, অভ্যন্তরীণ গণবিচ্ছিন্নতা থেকে সৃষ্ট গণবিক্ষোভ ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে তারা আপোষে যেতে বাধ্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে নির্ধারক হতে পারে উপরোক্ত কারিকাগুলোর ফলশ্রতিতে সৃষ্ট তৃতীয় শক্তির প্রয়োজনীয়তার যে জনপ্রিয়তা, তার মুখে সেনা-আমলাদের আস্থা হারানো। যদিও নির্বাচন পূর্বকালে সেটা কাজ করেনি, কিন্তু ভবিষ্যতে সেটা সম্ভব হতে পারে। কারণ, সামরিক আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনী দীর্ঘদিনের জন্য ভারতের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া কঠিন। অস্ত্রব্যবসা অনেক বেশি চীন ও মার্কিনী গোষ্ঠীর সাথে। যদিও রাশিয়াকে হাসিনা সরকার সুযোগ দিচ্ছে, তথাপি জাতিসংঘ বাহিনী ও বিবিধ মাধ্যমে এই সেনাবাহিনীর উপর মার্কিন প্রভাব অনেক বেশি স্থায়ী। সহসা তাকে উল্টে দেয়া সম্ভব নয়। সেটা আওয়ামী সরকারের বর্ধিত বিপদের কারণ হতে পারে।
এর সাথে যুক্ত হতে পারে আওয়ামী লীগ ও হাসিনা কর্তৃক বহুচর্চিত সংবিধানের দোহাই, অথচ তাদের দ্বারাই তার উপর্যুপরি লংঘন থেকে সৃষ্ট আইনী সমস্যা।
তবে এসব পরিণতির জন্য সংশ্লিষ্ট সকলেই সময় নিতে পারে।
৬। উপরোক্ত কারণগুলোর জন্য ক্ষমতার অব্যাহত রাখতে পারলেও আগামী পরিস্থিতিগুলো আওয়ামী লীগের জন্য মোটেই সুখকর হবে না। রাজনৈতিকভাবে শাসকশ্রেণির অন্যান্য পার্টি ও তাদের চিরায়ত বন্ধু অধিকাংশ বাম পার্টিদের থেকে বিচ্ছিন্নতা, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশের পক্ষ থেকে সমঝোতা ও নতুন নির্বাচনের দাবি ছাড়াও যুদ্ধাপরাধী বিচার ও জামাতবিরোধী কার্ড তার নিজের জন্যই বুমেরাং হতে পারে।
- যুদ্ধাপরাধী বিচার ও জামাত নিষিদ্ধের চাপ বিএনপির ঘাড়ে চাপানোর কৌশলটি এবার আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ঘাড়েই চাপবে। এটা আপাতত বিএনপির জন্য রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হবে। যুদ্ধাপরাধী বিচার কার্যকর করা এ সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য একটি স্থায়ী বিপদের সৃষ্টি করছে ও করবে।
জামাত কোন জঙ্গি মৌলবাদী পার্টি নয়, যা প্রায়শই আওয়ামীপন্থী বুর্জোয়া ও তথাকথিত বামরা বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও মতলববাজীর কারণে বলে থাকে। জামাত হলো ধর্মকে ব্যবহারকারী একটি বুর্জোয়া দল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের বিগত কয়েক দশকের ভূমিকা এটাই প্রমাণ করে। জামাত-কার্ড ব্যবহার করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র শাসকশ্রেণির জন্য নতুন সংকট ডেকে এনেছে। যুদ্ধাপরাধী বিচার ও জামাতের নিষিদ্ধকরণ জামাতের একটি অংশকে জঙ্গি তৎপরতায় ঠেলে দিতে পারে, যা দেশের রাজনীতিতে এক নতুন নেতিবাচক মাত্রা যুক্ত করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। শুধু জামাতই নয়, এটা প্রকৃত মৌলবাদী শক্তিগুলোকেও দ্রুত সেদিকে ঠেলে দেবে। এটা শুধু প্রগতিশীল আন্দোলন ও দেশের আগামী রাজনীতিক ভবিষ্যতের জন্যই সমস্যা হিসেবে আসবে তা নয়, শাসকশ্রেণিকেও এটা এক দীর্ঘস্থায়ী অনতিক্রম্য সংকটের আবর্তে নিক্ষেপ করবে। এ সমস্যা থেকে মুক্তির লক্ষে দ্রুত বিএনপি-কে ক্ষমতায় আনার জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও শাসকশ্রেণি নতুন নির্বাচনের দিকে যেতে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে পারে।
- তবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ (ও আওয়ামী লীগ) নিজেদের গণবিচ্ছিন্নতা ও ক্ষমতা হারানোকে ঠেকানোর জন্য আসলে সীমিত জঙ্গি মৌলবাদী উত্থানটাই চায় কিনা তা এক গুরুতর সন্দেহের বিষয়। তারা দেশে ও এ অঞ্চলে তা চাইতে পারে, কারণ তা তাদের রাজনীতিকে বৈধতা দেবে এবং বিএনপি-কে অপ্রয়োজনীয় করে তুলতে পারে বলে তারা মনে করতে পারে। তা সত্ত্বেও গোটা শাসক শ্রেণি এখনি সেটা চাইবে না, এবং ভারত-আওয়ামী লীগের কৌশল ব্যর্থ হতে পারে। আর যদি সেটাই কার্যকর হয় তবে দেশ ও জনগণকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এবং মৌলবাদ ও জঙ্গিবিরোধী সংগ্রামের নামে বিশ্বজনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরিকল্পনায় দাবার ঘুটে হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে দীর্ঘদিনের জন্য চরম দুর্গতিতে পড়তে হবে। যা এখন পাকিস্তানে চলছে। সকল প্রগতিশীল পার্টি ও জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদের বিপদ সম্পর্কে ভাল প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ-ভারতের মৌলবাদ ধুয়ার মুখোশ উন্মোচন করার দায়িত্ব সিরিয়াসলী গ্রহণ করতে হবে।
৭। নব্যরূপের বাকশালী শাসন ও ভারতের আক্রমণাত্মক কর্তৃত্ব সর্বস্তরের সাধারণ জনগণ-তো বটেই, তার সাথে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রভাবিত উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদেরসহ ক্ষুদ্র বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়া দলগুলোকেও অধিকারবঞ্চিত করছে ও করবে। শাসক শ্রেণির মধ্যেও এটা ঘোরতর বৈরিতা আরো বাড়িয়ে তুলবে। আর জনগণের জন্য এটা নগ্ন ফ্যাসিবাদী শাসনের বিপদ সৃষ্টি করছে ও করবে।
এ অবস্থায় এর বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনের বর্শামুখ কেন্দ্রীভূত করার বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। কৌশলগতভাবে একে সঠিকভাবে মিমাংসা করা উচিত হবে। এটা জনআন্দোলন এগিয়ে নেবার নতুন সুযোগও সৃষ্টি করছে ও করবে, যা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে।
৮। বিএনপি জোটের বিগত মরিয়া আন্দোলন ও ব্যাপক সহিংস তৎপরতা সত্ত্বেও, তাদের মূল দাবি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার প্রতি নিরংকুশ জনগণের সমর্থন সত্ত্বেও, আওয়ামী সরকারের ব্যাপক গণবিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও, বিশেষত তার দ্বারা একটি প্রচলিত নির্বাচন না করে একটি প্রহসন দ্বারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করা সত্ত্বেও এবং এই ফ্যাসিবাদের প্রতি ভারতের নির্লজ্জ মদদের প্রতি কোন গণসমর্থন না থাকা সত্ত্বেও আরো ৫ বছরের জন্য আওয়ামী সরকার টিকে যাবার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ ও সামরিক আমলাতন্ত্রের, অর্থাৎ দেশ ও জনগণের এই প্রধান শত্রদের সম্মিলিত সম্মতি ব্যতীত শাসক শ্রেণির কোন অংশের পক্ষেও আন্দোলনের দ্বারা সরকার বদল করা সম্ভব নয়। বিএনপি জোট রাজনৈতিকভাবে ও নৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অবৈধতা পুরোপুরি প্রমাণ করতে সক্ষম হলেও তারা সরকারকে সরাতে পারেনি।
এটা সত্য যে, লজ্জাহীন দালাল মিডিয়া, বিচার ব্যবস্থা, ব্যবসায়ী ও এনজিও-দের বিরাট অংশ আওয়ামী ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে তাদের কায়েমী স্বার্থেই বিরাট ভূমিকা রেখে থাকে। কিন্তু এটাও সত্য যে, এ সত্ত্বেও নির্বাচনী সরকার ব্যবস্থার বিতর্কে আওয়ামী লীগের সমর্থন নেই বললেই চলে। এ অবস্থাতেও শাসক শ্রেণি নিজেদের মধ্যেই সরকার বদলে সক্ষম হয়নি রাস্তার আন্দোলনের মাধ্যমে।
এটা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, এদেশে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিপ্লব-তো দূরের কথা, আওয়ামী ধরনের কোন ফ্যাসিস্ট সরকারকে শাসকশ্রেণির অন্য অংশের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়। এদেশ এখন প্রতিটি জনগণ-সম্পৃক্ত আন্দোলন সশস্ত্রতায় রূপ নেয় খুব দ্রুতই। বিএনপি জামাত যে সহিংস আন্দোলন কিছুদিন করেছে সেটা আন্দোলনের রূপ হিসেবে আসতে বাধ্য ছিল। কারণ, গণতান্ত্রিক আওয়ামী সরকার তার ক্ষমতার নিুতম ঝুকি নেয়নি এবং কোন গণতান্ত্রিক অহিংস তৎপরতাকেও অনুমতি দেয়নি। ফলে বিএনপি-জামাতের পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হলে পরবর্তী ধাপে সহিংসতায় যাওয়া ব্যতীত কোন পথই আর খোলা ছিল না। আওয়ামী অধীনে নির্বাচনে যাওয়াটা বিএনপি রাজনীতির জন্য একটি পরাজয় হতে বাধ্য ছিল, কারণ, আওয়ামী লীগ সে ধরনের কোন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনক্রমেই বিএনপির জয়লাভকে (যা প্রত্যাশিত ছিল) মেনে নিতো না। এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, জনগণ যদি ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম করেন, তবে কিছুটা ঝুঁকি হয়ো মাত্র তাকে এই রাষ্ট্র, সরকার ও শাসকশ্রেণি নিুতম কোন গণতান্ত্রিক সুযোগ দিতে পারে না। সেটা অসম্ভব। তাই জনগণের ক্ষমতাদখলের সংগ্রাম সহিংস পথ গ্রহণ না করে একটুও এগোতে পারে না।
সমস্যাটা আন্দোলনের সহিংস রূপে নয়, বরং বিএনপি-জামাতের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিতে। যে কারণে তাদের সহিংস আন্দোলন জনগণের সমর্থন হারাতে শুরু করেছিল। উপরন্তু তাদের সহিংস আন্দোলনও একটা মাত্রা ছাড়াতে পারে না, কারণ, তারা এই শাসকশ্রেণিরই অংশ। তারা সেটা বুঝেনা তা নয়। একারণেই তারা এখন পিছিয়ে এসেছে। যদিও আন্দোলনের এমন রূপ সাময়িকভাবে গ্রহণ করা ছাড়া আজকের বাংলাদেশে শাসকশ্রেণির কারও পক্ষেও ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম করা সম্ভব নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী জোটও একই কাজ করেছিল। বিএনপি সেই শিক্ষাই কাজে লাগিয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সঙ্গত কারণেই বিএনপি-কে সেদিকেই ঠেলে দিতে চেয়েছে। কারণ, তারা জানে যে, এ পথে সরকার পতন হয়না। ১৯৯৬ সালেও হয়নি। বিএনপির দাবিও অযৌক্তিক নয় যে, আন্দোলনে গণবিরোধী সহিংসতাগুলোর একাংশ রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ও খোদ আওয়ামী শক্তির দ্বারাই সংঘটিত ছিল।
- এ থেকে জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতার আন্দোলনের রূপ নিয়ে আবারো শিক্ষার রয়েছে। জনগণের ক্ষমতা দখল শুধু সহিংস পথেই হতে পারে। আর সেটা মাওবাদী গণযুদ্ধের পথ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রতিক্রিয়াশীলদের সহিংস আন্দোলন জনগণের উপর নিপীড়ন করে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে, জনগণকে নিপীড়ন করে এবং ফ্যাসিবাদী হয়ে পড়ে। বিপরীতে বিপ্লবী কর্মসূচির অধীনে জনগণের সহিংস সংগ্রাম জনগণের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করে এবং ক্রমবর্ধিত ভাবে গণসমর্থনে ধন্য হয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই পার্থক্য যারা বোঝে না তারা বিপ্লব ও কমিউনিস্ট আদর্শের কিছুই বোঝে না।
- ব্যাপকভাবে গণবিচ্ছিন্ন সশস্ত্রতা সত্ত্বেও বিএনপি-জামাত জোটের সহিংস আন্দোলনের জোয়ার সময়টাতে আওয়ামী সরকার কার্যত দেশের বহু অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। এটা প্রমাণ করে যে, জনসমর্থনপুস্ট ও তাদের অংশগ্রহণের দ্বারউন্মক্তকারী কোন সশস্ত্র আন্দোলনে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘাটি প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র ও সরকারকে যত শক্তিশালী দেখা যায় তারা ততটা শক্তিশালী নয়। বিভিন্ন এলাকার পুলিশ ফোর্সকে বলতে শোনা গেেেছ যে, তাদের লোকবল কম। আসলে লোকবল নয়, প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র সর্বদাই দুর্বল, যদি জনগণের বাহিনী থাকে, জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নেন, তারা গেরিলা আক্রমণের নীতি-কৌশল গ্রহণ করেন এবং তারা জনগণের মাঝে অবস্থান করেন।
৯। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের যে আবর্তে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে তা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। সেজন্য একটি প্রকৃত বিপ্লবী পার্টি গড়া, একটি বিপ্লবী কর্মসূচিকে তুলে ধরা, তার নেতৃত্বে একটি গেরিলা বাহিনী বিকশিত করা এবং সাহসী সংগ্রাম ও গণযুদ্ধ গড়ে তোলার এক স্বতন্ত্র নতুন পথে জনগণকে ও দেশকে পরিচালিত করতে হবে। তবেই চলমান বিষচক্র থেকে জনগণ ও দেশ মুক্ত হবে।
আমরা, সর্বহারা পার্টি, সে পথেই জনগণকে আহ্বান জানাই।

- কেন্দ্রীয় কমিটি, পূবাসপা।

No comments:

Post a Comment