পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
(সংশোধিত)
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, আমাদের দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু হয়েছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষেÑ গত শতাব্দীর ২০ দশকে। কিন্তু সেই আন্দোলনের অনেক ইতিবাচক অবদান সত্বেও একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন হিসেবে তা গড়ে ওঠেনি। ভারতবর্ষের পর পাকিস্তান আমলেও একই অবস্থা চলতে থাকে। ’৬০-এর দশকে এ দেশে সত্যিকার বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়- যা মাওবাদী আন্দোলন নামে পরিচিত। আমাদের পার্টি পুর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সেই আন্দালনেরই অংশ।
১৯৬৭ সলের মাঝামাঝি একটি সত্যিকার কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার লক্ষে ক. সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে অন্যান্য কিছু আন্তরিক বিপ্লবী প্রতিষ্ঠা করেন “মাওসেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার’’। এই সংগঠনটি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকাশে তৃতীয় স্তর হিসেবে মাওবাদ (তখন মাও চিন্তাধারা বলা হতো) উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা চালায় এবং নিজেদের মধ্যে তত্ত্বগত আলোচনা-বিতর্কের পর মাওবাদকে সর্বহারা শ্রেণীর মতবাদের বিকাশে তৃতীয় স্তর হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
তারপর এই নবীন বিপ্লবীরা ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারী পূর্ব বাংলায় একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার লক্ষে প্রস্তুতি সংগঠন ”পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠন পূর্ব বাংলায় নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের লক্ষে “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস” নামে একটি ঐতিহাসিক দলিল প্রণয়ন করে। এই সময় থেকেই পেশাদার বিপ্লবী কর্মী গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
’৭১-এর প্রথম দিকে পূর্ব বাংলার রাজনেতিক পরিস্থিতি অতিদ্রুত বিকশিত হতে থাকে। পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কবল থেকে পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের আকাংখায় এক গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলেন।
কিন্তু ২৫ মার্চ ’৭১ পাকিস্তানি সামরিক ফ্যাসিস্টরা গণহত্যা শুরু করে। বাঙালী উঠতি ধনিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় পাকিস্তানিদের কাছে আতœসমর্পণ করে এবং অন্যান্য নেতারা ভারতে পলায়ন করে। এরাই পরবর্তীতে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সহায়তায় পাকিস্তান বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। অন্যদিকে ক. সিরাজ সিকদার ব্যক্তিগত নেতৃত্বে আত্মনির্ভরশীলভাবে বরিশাল জেলার পেয়ারা বাগানে কৃষকদের উপর নির্ভর করে জাতীয় মুক্তির লক্ষে গণযুদ্ধ গড়ে তোলেন। অন্যান্য মাওপন্থী সংগঠনও দেশের মধ্যে থেকেই বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ শুরু করেন।
এই যুদ্ধের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ৩ জুন এক সম্মেলনের মাধ্যমে “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” বিলুপ্ত করে সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রসরদের নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি” প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন ক.সিরাজ সিকদার। এই পার্টি তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা।
’৭১-মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ভারত ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন বাহিনী বিশেষত: “মুজিব বাহিনী” মাওপন্থীদের হত্যা শুরু করে। ফলে মাওবাদীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় মদদপুষ্ট বাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেÑ দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হয়। সেপ্টেম্বর ’৭১ পাকিস্তানি ফ্যাসিস্টদের সর্বাত্মক আক্রমনের মুখে সিরাজ সিকদার পেয়ারাবাগান ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণ করেন এবং দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা দখল করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়।
ক.সিরাজ সিকদার পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পার্টির প্রথম কংগ্রেস সম্পন্ন করেন। কংগ্রেসে গৃহীত লাইন অনুসারে ’৭২ থেকেই পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুজিবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। অন্যান্য মাওপন্থী সংগঠনও সংগ্রাম করে। সারা দেশজুড়ে সর্বহারা পার্টিসহ মাওবাদী বিপ্লবীদের নেতৃত্বে বিপ্লবী রাজনীতির ব্যাপক প্রচার হয়। সশস্ত্র প্রচার, গণশত্র“ খতম, রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর অস্ত্র দখলসহ ব্যাপক সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালিত হয়। পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী বাহিনীর বিকাশ হতে থাকে। ’৭৪ সালের ১৫-১৬ ডিসেম্বর তথাকথিত বিজয় দিবসকে “কালো দিবস” ঘোষণা করে পার্টির আহবানে হরতাল পালিত হয়।
এসবের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার বর্বর ফ্যাসিবাদী দমন-নির্যাতন চালায়। ’৭৫ সালের ১ জানুয়ারী ক.সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হন এবং ২ জানুয়ারী মুজিব সরকার তাকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করে। অন্য মাওপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি (এমএল) নেতা মুনিরুজ্জামান তারা, বাদল দত্ত এবং সামবাদী দলের মন্টু মাষ্টার, এরাদ আলীসহ হাজার হাজার মাওবাদী নিহত ও গ্রেফতার হন। সংগ্রাম পরাজিত ও বিপর্যস্থ হয়।
ক. সিরাজ শিকদারের মৃত্যু, সরকারী ব্যাপক দমন-নির্যাতন, বিভিন্ন প্রশ্নে ভুল লাইনের ফলশ্র“তিতে পার্টি বিভক্ত হয়ে পড়ে। পার্টি শোচনীয় প্রতিকূলতায় পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এপ্রিল,’৭৭ পার্টি ক. আনোয়ার কবীরের নেতৃত্বে সারসংকলন প্রক্রিয়া শুরু করে এবং ’৭৯-এর এক বর্ধিত সম্মেলনে কিছু মৌলিক সারসংকলন গৃহীত হয়। ক. আনোয়ার কবীর সম্পাদক হিসেবে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হন। সেই সারসংকলনের ভিত্তিতে নতুনভাবে সংগঠন-সংগ্রাম বিকশিত হতে থাকে। পার্টির বিভিন্ন আন্তরিক বিপ্লবীগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন।
এই সময় ১৯৮৪ সালে “বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন”-এর সূচনা থেকেই তার সদস্য হয় পার্টি। অন্যদিকে ’৮৭-’৮৮ সালে দেশব্যাপী গণযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এই নতুন উত্থানের মধ্যেই ’৮৭ সালে প্রায় পনের বছর পর পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।
দেশব্যাপী বিপ্লবী সংগ্রামের বিকাশকে ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র পুনরায় ব্যাপক দমন-নির্যাতন শুরু করে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ক. রুমী-ক. সুভাসসহ অনেক কমরেড শহীদ হন। ’৮৮-’৮৯ সালে পুনরায় সংগ্রাম বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে।
এই বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে পার্টিতে পুনরায় নতুন সারসংকলন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নতুন এই সারসংকলন গ্রহণ এবং বিপর্যস্ত সংগঠনকে পুনর্গঠনের জন্য ১৯৯২ সালে পার্টির তৃতীয় জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসে গৃহীত লাইন অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় ’৯৪ সালে পার্টিতে বৃহৎ আকারে ২খঝ শুরু হয়। একদিকে বাস্তব বিপ্লবী অনুশীলন, অন্যদিকে ২খঝ ও সারসংকলন- এ প্রক্রিয়া চলে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। এই প্রক্রিয়ায় পার্টি বিগত চার দশকের মাওবাদী আন্দোলনের একটি সামগ্রিক লাইনগত সারসংকলন করেÑ যা “নতুন থিসিস” নামে পরিচিত।
এই নতুন থিসিস অতীত মাওবাদী আন্দোলন সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করে তাহলো- ’৬০-’৭০দশকে মাওবাদী আন্দোলনের সূচনা পর্ব, যা মাওবাদী আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। তারপরে বিপর্যয় এবং ’৮০-এর দশকে নতুন সারসংকলন-নতুন বিকাশÑ কিন্তু সীমা ছাড়াতে না পারা। ’৯০ দশকে রাপচার শুরু, কিন্তু অসম্পূর্ণ। ২০০২ সালে নতুন শতাব্দীতে পরিপূর্ণ রাপচার শুরু এবং ধাপে ধাপে আমাদের দেশের বিগত মাওবাদী আন্দোলনের চার দশকের একটি লাইনগত সারসংকলন। একে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের নতুন যুগ বলা হয়।
এই সারসংকলন প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন পার্টির সম্পাদক ক.আনোয়ার কবীর। এখন সেই নতুন থিসিসের ভিত্তিতে একটি নতুন ধরনের পার্টি এবং নতুন ধরনের গণযুদ্ধ গড়ে তোলার জন্য সুনির্দিষ্ট রণনৈতিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে পার্টি ও বিপ্লবী সংগ্রাম এগিয়ে যাচ্ছে। পার্টির একটি তাত্ত্বিক মুখপত্র রয়েছে যার নাম “স্ফুলিঙ্গ”। বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ২খঝ পার্টির ভেতরে ও বাহিরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য “নয়া বিতর্ক” নামে একটি তাত্ত্বিক পত্রিকা, “সহযোদ্ধা” নামে অনিয়মিত সাংস্কৃতিক পত্রিকা এবং গণ-রাজনৈতিক বুলেটিন “গণযুদ্ধ” নামে আরো একটি মুখপত্র প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া পার্টির নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন ধরনের গণসংগঠন এবং তাদের দলিলপত্রও রয়েছে।
মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সমাজ বিকাশ লাভ করে। আমাদের পার্টিও দুই লাইনের সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়েছে ও হচ্ছে। নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে গণযুদ্ধ গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে পার্টি অগ্রসর হচ্ছে। সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
-আগস্ট, ২০১৩।
No comments:
Post a Comment